আগামী জাতীয় নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে সরকারবিরোধী জোট স্পষ্টই দুটি মত দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আগামী নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবিতে এক মঞ্চে আন্দোলন করলেও এখন ভিন্নমত প্রকাশ করছে জোটের শরিকরা। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক জেএসডি এবং ২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক এলডিপি বলছে, জাতীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হওয়া উচিত। মাত্র তিন মাসে নির্দলীয় ব্যক্তিদের পক্ষে দলীয়করণে দুষ্ট রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে মেরামত করে সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়া সম্ভব হবে না।
ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও দল দুটির সঙ্গে একই সুরে কথা বলছেন। আবার ঐক্যফ্রন্টের আরেক শরিক নাগরিক ঐক্য জাতীয় সরকার এবং নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে আপত্তি তুলছে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হতে হবে। দলীয় সরকারের পক্ষে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। সমমনা দলগুলোর মধ্যে হঠাৎ কেন মতান্তর- এমন প্রশ্নের জবাবে নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন বিরোধী শিবিরের শীর্ষ নেতারা। আবার তারা এও আশা করছেন, আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা হবে।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বলেছেন, বিষয়টি আলাদা করে দেখছেন না তারা। প্রতিটি দলেরই বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে। কেউ যদি জাতীয় সরকারের কথা বলে থাকে, এটা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন। এটি নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি হবে না। বড় কোনো সমস্যাও হবে না। সার্বিক বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। আলোচনার মধ্যে সব ইস্যুতে ঐকমত্য হবে বলে আশা করছেন তিনি। একই সঙ্গে মির্জা ফখরুল এও বলেন, আমাদের দলের দাবি- কোনো দলীয় সরকার নয়, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।
বিএনপির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, বিগত ১৩ বছরে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেআইনি ও সংবিধানবহির্ভূতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। সুতরাং এই ক্ষত দূর করা ছাড়া অর্থাৎ রাষ্ট্র মেরামত করা ছাড়া জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এ জন্য নূ্যনতম ও প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে আমি জাতীয় সরকারের আহ্বান জানিয়েছি।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, আমার বক্তব্য খুবই স্পষ্ট- বিগত প্রায় ১৫ বছরে সারাদেশে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশ তিন মাস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে গেলেও যেভাবে প্রশাসন আওয়ামী লীগ ক্যাডার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাতে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না। আর অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশ ছাড়া অন্য কারও বিজয়ী হয়েও আসা সম্ভব হবে না। বর্তমান অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা অবান্তর। নির্দলীয় সরকার অল্প সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক ক্যাডারদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ থেকে সরাতে পারবে না। রাজনৈতিক নিয়োগ কর্মকর্তাদের হাত থেকে প্রশাসনকে মুক্ত না করা পর্যন্ত দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সর্বোপরি জনগণের সরকারও প্রতিষ্ঠা হবে না।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, জাতীয় বা সর্বদলীয় সরকারে সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে। এতে আওয়ামী লীগ ভয় পাবে না। কেউ কারও পক্ষ নিয়ে ভোটচুরি করতে পারবে না। একই সঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা প্রকাশ করুক। নির্বাচনকালীন জাতীয় বা সর্বদলীয় সরকার থাকলে সব দলই সরকারে থাকবে, কেউ এককভাবে কোনো অনিয়ম করতে পারবে না।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, জাতীয় সরকার বললে একটি চরিত্র দাঁড়ায়। যাতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের অংশগ্রহণ থাকবে। এত আন্দোলন-সংগ্রাম করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবার তাদের নিয়েই জাতীয় সরকার হলে বিষয়টি কেমন হবে। বিশেষ করে প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয়করণ করা হয়েছে, তাদের সরাতে হবে। অন্যথায় তারা আবারও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে চাইবে। আবার বিএনপি যে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছে, তাতে নিরপেক্ষ সরকারে যারা আসবে তারা আওয়ামী লীগের দোষী কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না। আমার দলের অবস্থান অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করার মতো সরকারের প্রয়োজন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা চলছে এবং আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছি।
বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই কার্যত নিস্ক্রিয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট। নির্বাচনে ফল বিপর্যয়, আগের রাতে ভোট কারচুপির অভিযোগ এবং সংসদে যোগ দেওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে চলছে টানাপোড়েন। দলগত বিভিন্ন কিছু কর্মসূচি বা সমমনা অন্য দলগুলোর কর্মসূচিতে বিচ্ছিন্নভাবে নেতারা যোগ দিলেও জোটগত কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠকে এখনও বসেনি তারা।
এ পরিস্থিতিতে বিগত দুই মাস আগে প্রথম জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জোটের শরিক জেএসডির পক্ষ থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রথম সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সরকারের দাবি তুলে ধরা হয়। এ দাবির পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছে দলটি। একই সঙ্গে দাবির পক্ষে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ইতোমধ্যে পুরোনো ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এলডিপিও জাতীয় সরকারের পক্ষে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া শুরু করেছে। অথচ একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ইসিতে স্মারকলিপি দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ফ্রন্ট নেতাদের পাশে বসিয়ে ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের ফল বাতিল ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনরায় নির্বাচন চায় ঐক্যফ্রন্ট।’
ওই সংবাদ সম্মেলনে ফখরুলের পাশে বসা ছিলেন জেএসডি সভাতি আ স ম রব। গত ২ মার্চ স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন দিবসের ৫১ বছর উদযাপন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে আর নির্বাচন নয়। গণআন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তির সমন্বয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গড়ে তুলতে হবে। একই অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে দুই বছরের জন্য জাতীয় সরকার গঠন করুন। জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে এ দেশে কোনোভাবেই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা যাবে না, সুষ্ঠু নির্বাচনও হবে না। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এখনও নির্দলীয় সরকার চান। সম্প্রতি গণফোরামের কর্মসূচিতেও তিনি বলেছেন, আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নেওয়ার দাবি জানাই। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হয় না।
সূত্র জানায়, নির্দলীয় সরকারের দাবির অবস্থান থেকে জাতীয় সরকারের দাবিতে স্থানান্তর হওয়ার বিষয়ে নানা যুক্তি দিচ্ছে দলগুলো। নেতারা মনে করেন, বর্তমানে রাষ্ট্রের যে দুরবস্থা, তাতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে তা সমাধান করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংস্কার করতে হবে। দলীয়করণের কারণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে। দেশের শাসনতন্ত্রের গতিতে সংস্কার করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সংস্কার করতে হবে। বিচারব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ করতে হবে। শুধু সুষ্ঠু ভোট দিয়ে কিছু রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় এনে রাষ্ট্রের সমস্যা সমাধান হবে না।
সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় সরকারের পক্ষে ইতোমধ্যে সমমনা গণফোরাম (মন্টু), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার, গণঅধিকার পরিষদ প্রভৃতি দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে। জাতীয় সরকারের উদ্যোগকে সমর্থনকারী একজন নেতা জানান, ঐক্যফ্রন্ট সক্রিয় না থাকায় তারা সমমনা দলগুলোকে নিয়ে একই ইস্যুতে মাঠে নামছেন। বিএনপির সঙ্গেও আলোচনা চলছে। মাঠের দেখায় জোট হবে। তাতে যুগপৎ আন্দোলন বা একমঞ্চ থেকেও আন্দোলন হতে পারে।
অন্যদিকে, বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, জাতীয় সরকারের পক্ষে যারা কথা বলছেন, তারা নিজেদের স্বার্থেই কথা বলছেন। সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারা আশানুরূপ মূল্যায়ন না পাওয়ার শঙ্কা থেকে জাতীয় সরকারের দাবিতে একাট্টা হতে পারেন। অনির্বাচিত জাতীয় সরকারের অধীনে দুই বছর রাষ্ট্র চলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে বিএনপি তাদের সঙ্গে আলোচনা করবে। আশা করছেন, আলোচনার মাধ্যমে তিন মাসের মধ্যেই নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে ঢেলে সাজানোর দাবিতে একটি ফর্মুলা বের করতে সক্ষম হবেন।