দেশের শেয়ার বাজারের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দর কমেছে বেশির ভাগ শেয়ারের। গত সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনই ছিল পতন ধারায়। একটানা পতনে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। এর আগের সপ্তাহে ডিএসইতে বাজার মূলধন কমেছিল ১০ হাজার ৫৭৩ কোটি ৮৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। ফলে গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমলো ২২ হাজার কোটি টাকার উপরে। আর টানা তিন সপ্তাহের পতনে ডিএসই হারিয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন। একইসঙ্গে কমেছে সবক’টি মূল্যসূচক ও লেনদেনের পরিমাণ।
যুদ্ধের আতঙ্কে ডিএসই’র বৃহস্পতিবার (৩রা মার্চ) লেনদেন নেমেছে ৬৪৫ কোটি টাকায়। প্রায় ১১ মাসের ব্যবধানে এটিই সর্বনিম্ন লেনদেন। এর আগে সর্বশেষ গত বছরের ১৮ই এপ্রিল ডিএসইতে সর্বনিম্ন ৬০৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবরের একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব দেশের পুঁজি বাজারে পড়েছে। যুদ্ধের ফলে তেলের দাম বেড়ে যাবে- এর একটা প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে পড়বে। সেটার প্রভাব পুঁজি বাজারে চলে আসবে। দরপতনের কারণে বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ হঠাৎ অনেক কমে গেছে। তবে আশা এমন পতন সামনে থাকবে না।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, এখন মানুষ অনেক ভয়ে আছে। আস্তে আস্তে এ ভয় কেটে যাবে। মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বা অস্থিরতা কমে গেলে বাজারের পতনও থেমে যাবে। বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে গত সপ্তাহের শুরুতে বাজার মূলধন ছিল ৫ লাখ ৫০ হাজার ৩৫৫ কোটি ৯৮ লাখ ৭ হাজার ৯০৬ টাকা। সপ্তাহের শেষদিন বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৪২৭ কোটি ৪১ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩৪ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমেছে ১১ হাজার ৯২৮ কোটি ৫৬ লাখ ১৪ হাজার ৩৭২ টাকা। এর আগের সপ্তাহে ডিএসইতে বাজার মূলধন কমেছিল ১০ হাজার ৫৭৩ কোটি ৮৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। ফলে গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমলো ২২ হাজার কোটি টাকার উপরে। আর টানা তিন সপ্তাহের পতনে ডিএসই হারিয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন। গতকাল সাপ্তাহিক শেয়ারবাজার পর্যালোচনায় এসব তথ্য জানা গেছে।
বাজার মূলধন বাড়া বা কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ বেড়েছে বা কমেছে। অর্থাৎ বাজার মূলধন বাড়লে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। একইভাবে বাজার মূলধন কমলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ কমে যায়। বাজার মূলধন কমার পাশাপাশি গেল সপ্তাহে ডিএসইতে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমছে। সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া ৫৫টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৩১৯টির। আর ১২টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
ডিএসইতে গত সপ্তাহে ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি ৮৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬২৫ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ৩ হাজার ৯৮৭ কোটি ৮৯ লাখ ২৫ হাজার ২৯৫ টাকার শেয়ার ও ইউনিট। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইতে লেনদেন ২৪২ কোটি ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৬৭০ টাকা বা ৬ শতাংশ কমেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৪২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৯৬ পয়েন্টে। অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরীয়া সূচক ৩৩ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৪৪১ পয়েন্টে এবং ডিএসই-৩০ সূচক ৫২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৬২ পয়েন্টে।
এদিকে গত সপ্তাহে ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর শেয়ার। সপ্তাহজুড়ে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩৭৭ কোটি ৪০ লাখ ৬৭ হাজার টাকা, যা মোট লেনদেনের ১০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৮১ কোটি ২১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। ১১২ কোটি ৩৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে সোনালী পেপার। এ ছাড়া লেনদেনের শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- ফরচুন সুজ, ওরিয়ন ফার্মা, বৃটিশ আমেরিকান টোবাকো, সাইফ পাওয়ারটেক, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং ড্রাগন সোয়েটার।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) বিদায়ী সপ্তাহে টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ১৩৪ কোটি ২১ লাখ ৬২ হাজার ১৯৮ টাকার। আর আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ১২৩ কোটি ৯০ লাখ ৭২ হাজার ২৩৪ টাকার। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে সিএসইতে লেনদেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ৯৬৪ টাকা বা ৮ শতাংশ বেড়েছে। সপ্তাহটিতে সিএসই’র সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৪১৯.৫৩ পয়েন্ট বা ২.০৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৫৭২.০২ পয়েন্টে। সিএসই’র অপর সূচকগুলোর মধ্যে সিএসসিএক্স ২৫২.৮৮ পয়েন্ট বা ২.১০ শতাংশ, সিএসই-৩০ সূচক ২৩৩.৯৭ পয়েন্ট বা ১.৬৫ শতাংশ, সিএসই-৫০ সূচক ২৮.৯৯ পয়েন্ট বা ১.৭০ শতাংশ এবং সিএসআই ৩১.৪৯ পয়েন্ট বা ২.৫২ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১১ হাজার ৭৪৬.৩৭ পয়েন্টে, ১৩ হাজার ৯১৩.৮৮ পয়েন্টে, এক হাজার ৪৪৮.৭৭ পয়েন্টে এবং সিএসআই এক হাজার ২১৬.৯৫ পয়েন্টে। সপ্তাহজুড়ে সিএসইতে ৩৪৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেনে অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪৭টির বা ১৩.৬৬ শতাংশের দর বেড়েছে, ২৪৬টির বা ৮৩.১৪ শতাংশের কমেছে এবং ১১টির বা ৩.২০ শতাংশের দর অপরিবর্তিত রয়েছে।
গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর খবরে কয়েক দিনে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যে সূচক কমেছে সেটা অযৌক্তিক। তিনি বলেন, দু’টি কারণ গণমাধ্যমগুলোতে এসেছে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তেলের দাম। তার মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের দেশের অর্থনীতির সঙ্গে কতটুকু সংযুক্ত সেটা আমাদের বিবেচনা করতে হবে। রাশিয়ার অর্থনীতি পৃথিবীর মধ্যে ১২তম অর্থনীতি। এটি প্রথম ৫টি বা ১০টির মধ্যে নেই। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতি, আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতি হবো। আমাদের কিন্তু সে রকম ডিপেন্ডেন্সি নেই রাশিয়ার উপর। ফলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যে খারাপ প্রভাব পড়েছে সেটা অযৌক্তিক।