দু’দিনের তপ্ত বিতর্কের পর বুধবার (বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বিরল অধিবেশনে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছে। ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে ১৪১-৫ ভোটে পাস হওয়া ওই প্রস্তাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত (অ্যাবস্টেইন) ছিল বাংলাদেশ। ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ আরও ৩৪ রাষ্ট্র একইভাবে ভোটাভুটি থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের দূরে রেখেছে। সাধারণ পরিষদে ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে চলা জমজমাট বিতর্ক এবং ভোটাভুটির সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন নিউইয়র্কেই ছিলেন। কূটনৈতিক সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, ভোটদানে বিরত থাকলেও সংলাপ এবং কূটনৈতিক সমাধানের মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন- দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কার্যকর উদ্যোগের জোর দাবি জানিয়েছে।
একদিন আগেই জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের ডেপুটি চিফ অব মিশন (মিনিস্টার) মনোয়ার হোসেন তার আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে তা তুলে ধরেন। সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে নানা বিশ্লেষণ ছাপা হচ্ছে। প্রতিবেশি দেশগুলোর মিডিয়াতেও নিজ নিজ রাষ্ট্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করে সংবাদ প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে।
কিন্ত বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, ইরিত্রিয়া এবং সিরিয়া ছাড়া আর কাউকেই তারা তাদের পাশে পায়নি। ভোটাভুটিতে উল্লেখিত ৪ সদস্য রাষ্ট্র নিন্দা প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে সরাসরি ‘না’ ভোট দিয়েছে। জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশন এবং নিউইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্র বলছে, প্রস্তাবের সরাসরি পক্ষ বা বিপক্ষ কিংবা নিরপেক্ষ থাকতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকলেও ১৯৩ সদস্যের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মোটাদাগে ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে শঙ্কিত দুনিয়া।
বাংলাদেশের চাওয়া
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা প্রশ্নে আহুত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের জরুরি বৈঠকে বাংলাদেশ ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান গ্রহণ করে। মঙ্গলবার পরিষদের বিতর্কে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ জাতিসংঘ মহাসচিবের নেতৃত্বে সংলাপের মাধ্যমে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান কামনা করে। পাশাপাশি জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখণ্ডতার নীতির প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে ঢাকা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের উপপ্রধান মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন তার বক্তব্যে কূটনৈতিক সমাধানে উদ্যোগী হতে মহাসচিবকে অনুরোধের পাশাপাশি যুদ্ধপীড়িত অঞ্চল থেকে সরে যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। ঢাকার ওই চাওয়া বা অবস্থানে ব্যাখ্যায়
নিউইয়র্ক সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন স্থানীয় একটি বাংলা টিভির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা সব রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগে এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক, আমরা সেটাই চাই। ক্ষুদ্র দেশ হিসেবে সব রকম যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সংকট বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। ইউক্রেন ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব রাশিয়ার ভেটোর কারণে আটকে যাওয়ায় সাধারণ পরিষদের ওই বিরল অধিবেশন ডাকা হয়। সোমবার বিতর্কের সূত্রপাত করে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ বলেন, যথেষ্ট হয়েছে, ইউক্রেনে হামলা এখনই বন্ধ করতে হবে। বেসামরিক এলাকায় রুশ বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণের নিন্দা করে তিনি ইউক্রেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানার ওপর তার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক সংহতি রক্ষার ওপর জোর দেন।
সোম ও মঙ্গলবার এই বিতর্কে যেসব দেশ অংশগ্রহণ করে, তাদের অনেকেই ইউক্রেনে হামলার জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করে। শুধু পশ্চিমা দেশগুলোই নয়, তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে বর্ণনা করে।
ভারতের অবস্থান অপরিবর্তিত
রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত এ আগ্রাসনের জন্য মস্কোকে দায়ী করার বদলে কূটনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের তাগিদ দিচ্ছে। গত সপ্তাহে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত নিন্দা প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত থাকা ছিল ভারতের ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানের বড় প্রকাশ। বুধবার সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতেও ভোটদানে বিরত (অ্যবস্টেইন) থাকার মধ্য দিয়ে দিল্লি তার পূর্বের অবস্থান ধরে রেখেছে। যদিও এ নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বহুমুখী কথাবার্তা হচ্ছে। পুরনো মিত্র এবং দীর্ঘদিনের অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সমালোচনার বদলে ভারত মস্কো-কিয়েভ শত্রুতা বন্ধ এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে দেখতে চায়। মোদি সরকারের এ অবস্থান প্রশ্নে ভারতের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক কংগ্রেস দলীয় নেতা (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) পি চিদাম্বরম এক টুইট বার্তায় বলেন, ভারত সরকারের মুখে মুখে ভারসাম্য বজায় রাখা বন্ধ করা উচিত। ইউক্রেনের প্রধান শহরগুলোতে বোমা হামলা অবিলম্বে বন্ধের দাবি কঠোরভাবে রাশিয়ার কাছে তোলা উচিত। উল্লেখ্য, সাধারণ পরিষদের বিতর্কে অংশগ্রহণ করে ভারতীয় প্রতিনিধি টি এস ত্রিমূর্তি অবিলম্বে সংঘর্ষ বন্ধের আহ্বান পূনর্ব্যক্ত করেন। বলেন, কূটনৈতিক উপায় ছাড়া এ সংকটের অন্য কোনো সমাধান নেই। তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির টেলিফোনে আলোচনার কথা উল্লেখ করে সব পক্ষকে আন্তর্জাতিক আইন, জাতীয় সংহতি ও সার্বভৌমত্বের নীতি মেনে চলার আহ্বানও জানান।