নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে ছাপিয়ে এখন মূল্যস্ফীতি আঘাত করেছে উচ্চমধ্যবিত্তকেও। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মধ্যবিত্তরা পারিবারিক বাজেট কাটছাঁট করে চলছেন। কেউ কেউ হাত দিচ্ছে সঞ্চয়ের ওপর। আর নিম্নবিত্তরা জড়িয়ে পড়ছেন ধারদেনায়। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাবে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে চোখ রাঙাচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ। পাশাপাশি শিগগিরই আসছে রোজা। এই দুই ইস্যু দেশের মূল্যস্ফীতিকে আরেক দফা উসকে দেওয়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
কারণ এ যুদ্ধে বিশ্ববাজারের জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীলতা ভেঙে দিয়েছে। আর রোজা এলেই পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া যেন স্থায়ী সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। এখন নতুন বাজেটের কাজ শুরু হয়েছে। আসন্ন বাজেটে প্রবৃদ্ধি নয়, সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে মূল্যস্ফীতিকে। পাশাপাশি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যাতে কোনো মহল পণ্যের বাজারে বেশি মুনাফা না করে, সেজন্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে বাজার মনিটরিং, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সার্বিক সহায়তা ও টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি বাড়ানোর সুপারিশও করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র মতে, অর্থবছরের (জুলাই) শুরুতে সবকিছু স্বাভাবিক থাকবে-এমনটি ধরে নিয়ে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু পরিস্থিতি পালটে যাওয়ায় এই ঘোষণার পাঁচ মাসের মাথায় অর্থাৎ ডিসেম্বরে তা সংশোধন করে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করা হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার নিজেই মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আগামী বাজেটে প্রবৃদ্ধির একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে। এ বছর সে ধরনের লক্ষ্যমাত্রা না করলেও সমস্যা নেই। প্রবৃদ্ধি সামান্য হলেও ভালো। ফলে প্রবৃদ্ধিকে নয়, গুরুত্ব দিতে হবে মূল্যস্ফীতিকে। কারণ মূল্যস্ফীতি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও আঘাত করেছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত মানুষ বেশি সমস্যায় পড়েছে। অনেকে সঞ্চয়পত্রের আয় দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তারা সঞ্চয়পত্রের যে সুদ পাচ্ছে সেটি বাড়েনি। মূল্যস্ফীতি অনেকটা খেয়ে ফেলছে। সীমিত আয়ের মানুষও দিন চালাতে পারছে না। এজন্য আগামীতে রাজস্ব ও মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
বিআইডিএস’র সাবেক ডিজি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, এখন দেশে মূল্যস্ফীতির প্রবণতা বিদ্যমান। আরও দুটি কারণে মূল্যস্ফীতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রথমত, ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় আসন্ন রোজার মাস। ঐতিহাসিকভাবে রোজা এলেই জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পায়। যেভাবেই হোক সেটি বাড়ে। আর সম্প্রতি যুদ্ধ বিশ্ববাজারে মূল্য খাতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের বাজারে আঘাত আসবে। আমরা যুদ্ধরত দেশগুলো থেকে গম, ভোজ্যতেল, ভুট্টা আমদানি করছি। এসব পণ্যের দাম বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারের কারণে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে যতটুকু বৃদ্ধির কথা কতিপয় ব্যবসায়ী তার চেয়ে বেশি বৃদ্ধি করে থাকেন। এজন্য সরকারকে পণ্যের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। জানা গেছে, বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ভেজিটেবল ওয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যাসোসিয়েশন প্রতি লিটার ভোজ্যতেল ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এ প্রস্তাব দিয়ে আগামী পহেলা মার্চ থেকে এটি কার্যকর করতে বলা হয়। এরই মধ্যে গত এক সপ্তাহে বাজারে সবকিছুর দাম আরেক দফা লাফ দিয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা টিসিবির হিসাবে গত এক সপ্তাহে চাল, ময়দা, ভোজ্যতেল, আমদানিকৃত পেঁয়াজ, এমএস রডের দাম বেড়েছে। এসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে মোটা চাল ৩.২৩ শতাংশ, মাঝারি চাল ১.৮৯ শতাংশ, সরু ৩.১৩ শতাংশ বেড়েছে এক সপ্তাহে। এছাড়া খোলা ও প্যাকেটজাত ময়দার কেজিতে ২ টাকা, লুজ সয়াবিন লিটারে ৫ টাকা, লুজ সয়াবিনের লিটারে ১০ টাকা বেড়েছে। বেড়েছে আলু, জিরা, লবঙ্গ ও মুরগির দামও।
মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে সামলাচ্ছেন নিজের সংসার জানতে চাইলে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের ঝাউচর এলাকার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা মো. আজিজ জানান, প্রতিমাসে একবার ভালো খাবারের উদ্দেশ্যে মাংস খাওয়ার অভ্যাসটুকু এখন বাদ দিয়েছেন। ৫শ টাকা দিয়ে ডানো দুধের প্যাকেট কেনার অভ্যাস থাকলেও তা বাদ দিয়ে মুদি দোকান থেকে এখন ৩০ টাকা মূল্যের মিনি প্যাকেট কিনছেন।
তার মতে, এই সময়ে কাজকর্ম কমে গেছে। তিনি পেশায় একজন স্যানিটারি মিস্ত্রি। উন্নয়ন উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যক্তি পর্যায়ে নির্মাণকাজ স্থবির হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন আজিজ। ফলে তাদের কাজও কমেছে। অপরদিকে বাজারের উত্তাপ। এটি সামাল দিতে না পেরে গত তিন মাসের ভাড়া বকেয়ায় ফেলছেন। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের বাসিন্দা তিনি কাজের কারণে থাকেন কামরাঙ্গীরচরে। প্রতিমাসে তার ঘর ভাড়া গুনতে হয় ৪ হাজার টাকা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার ভোগ্যপণ্যের বাজার করে তিনজনের সংসার চলে যেত। সেটি এখন সম্ভব হচ্ছে না। আজিজের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।
এদিকে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে টিসিবির লাইনে এখন অনেক মধ্যবিত্তকে দেখা যাচ্ছে। নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ন্যায্যমূল্যের টিসিবির পণ্য এখন মধ্যবিত্তরা কিনছেন। যে কারণে টিসিবির ট্রাকের সামনে অসংখ্য মানুষের ভিড় প্রতিদিনই বাড়ছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ভোগ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে আঘাত আসবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের স্থিতিশীলতাকে ব্যাঘাত করেছে। এছাড়া রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত আমদানি হচ্ছে তুলা, গম, ভুট্টা, সরিষা, মসুর ডাল। দেশে বছরে গমের চাহিদা সর্বোচ্চ ৭০ লাখ টনের মধ্যে ৩৫ লাখ টন আসছে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। এ গম প্রক্রিয়াজাত করে ময়দা, আটা, সুজিসহ বিভিন্ন উপজাত পণ্য উৎপাদন হয়ে থাকে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ইতোমধ্যে বেড়েছে।
উদ্ভূত অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে রাশিয়া, ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি কার্যক্রম স্থগিত রাখতে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়েছেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযান শুরু হওয়ার দিন থেকেই ব্যবসায়ীদের এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দেশে আমদানিকারকদের বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মূল কারণ ওই দুদেশ থেকে পণ্যবোঝাই করতে কোনো দেশের জাহাজ মালিক এ মুহূর্তে রাজি নয়।
মূল্যস্ফীতির একটি বড় উপকরণ হচ্ছে জ্বালানি তেল। এর মূল্য বাড়লে পণ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌঁছতে সর্বক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ে। এতে শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়। যা মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সম্প্রতি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী বিরাজ করছে। যুদ্ধের কারণে এটি প্রায় ১শ মার্কিন ডলারে উঠেছে। এদিকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করছে ভারত ও চীন থেকে। বর্তমানে এ দুটি দেশের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী বিরাজ করছে। যার প্রভাব পড়ছে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে।