আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ১০ই ডিসেম্বর র্যাবের বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের। বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যুকে বিচারবহির্ভূত হত্যা বলে দাবি করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর এ ধরনের মৃত্যু একেবারেই কমে গেছে। নিষেধাজ্ঞার পর প্রায় আড়াই মাসে কোনো বন্দুকযুদ্ধের তথ্য সামনে আসেনি। এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও জানানো হয়নি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘বন্দুকযুদ্ধে’র এই বিরতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবসময় একটি নির্দিষ্ট ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করে। মানুষের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে কখনো যদি পুলিশ সদস্যরা মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়েন তখনই কিন্তু পাল্টা গুলি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার কমেছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না। কারণ পুলিশ সাধারণ নিরাপত্তার জন্য কাজ করে। কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার কারণে পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রমে তো প্রভাব পড়তে পারে না।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যমতে ২০২১ সালে সারা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৮০টি। এরমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ৫১ জন। গ্রেপ্তারের আগে ৪৮ জন ও গ্রেপ্তারের পরে ৩ জন। ওই বছর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৩০ জন, পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৫ জন, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৪ জন এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে ক্রসফায়ারে আরও ১২ জনের মৃত্যু হয়।
সংস্থাটির তথ্য মতে, ২০২০ সালে মোট ২২২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরমধ্যে ক্রসফায়ারে মৃত্যু হয় ১৮৮ জনের। গ্রেপ্তারের আগে ১৪৯ জন ও গ্রেপ্তারের পরে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়। ওই বছর র্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৬০ জন, পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৯০ জন, ডিবি’র সঙ্গে ক্রসফায়ারে ১৩ জন এবং বিজিবি’র সঙ্গে ক্রসফায়ারে ২৫ জনের মৃত্যু হয়।
২০১৯ সালে মোট বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩৮৮টি। এরমধ্যে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ৩৫৬ জন। গ্রেপ্তারের আগে ২৬৭ জন ও পরে ৮৯ জন। ওই বছর র্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ারে ১০১ জন, পুলিশের সঙ্গে ১৭২ জন, ডিবি’র সঙ্গে ৩০ জন, বিজিবি’র সঙ্গে ক্রসফায়ারে ৫১ জন, কোস্টগার্ডের সঙ্গে ক্রসফায়ারে ১ জনের ও জয়েন্ট ফোর্স কর্তৃক ১ জন ক্রসফায়ারের শিকার হন। এর আগে ২০১৮ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৪৬৬ জন। ২০১৭ সালে ১৬২ জন, ২০১৬ সালে ১৯৫ জন ও ২০১৫ সালে ১৯২ জন।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২ জন। তবে চলতি মাসে কোনো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি। আসকে’র তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্রসফায়ারের ঘটনা ছিল ২টি। ফেব্রুয়ারিতে ৭টি, মার্চে ৩টি, এপ্রিলে ১টি, মে মাসে ৪টি, জুনে ৩টি, জুলাইতে ৬টি, আগস্টে ৫টি, সেপ্টেম্বরে ৩টি, অক্টোবরে ২টি, নভেম্বরে ৭টি ও ডিসেম্বরে ৮টি। তবে ডিসেম্বরের ঘটনাগুলো ১০ই ডিসেম্বরের আগে।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো খুব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছিল। এর দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনই এড়াতে পারে না। যদি প্রকৃতপক্ষে উভয়পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হতো এবং এটা যদি সাজানো নাটক না হতো তাহলে কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড এখনো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত ১০ই ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কতিপয় বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর থেকে কোনো ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রায় শূন্যের কোঠায়। লিটন বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টারের নামে যে ঘটনাগুলো ঘটছে এটা আসলে ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড’। আমরা এজন্য বিচার বিভাগীয় একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন করার দাবি করেছিলাম। তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। যারা অপরাধী তাদেরকে চিহ্নিত করুক। মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পরে প্রায় দুই থেকে তিন মাস এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। পরবর্তীতে যদিও আবারো হয়েছে। ঠিক এখনো এরকম একটি বিরতি চলছে। তাই এখনই বলার সুযোগ নেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আর ঘটবে না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনো পরিস্থিতিতেই কাম্য নয়। আমরা দেড় বছর ধরে এটা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছি এবং জড়িতদের এসব অপরাধের জন্য বিচারের কথা বলছি। যে কোনো কারণে সেটা আমাদের নাগরিকদের চাপ, অন্যদের সমালোচনা অথবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের চাপে, যেভাবেই হোক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সেটা আমাদের রাষ্ট্র ও আইনের শাসনের জন্য মঙ্গল।
‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অনেকটাই কমে এসেছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। এতে আমরা খুশি। এই নিষেধাজ্ঞাটা যদি আরও আগে হতো তাহলে হয়তো আরও ভালো হতো। গত কয়েক মাস ধরে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ আছে। এরপরে যে তারা এটা করবে না সেটার নিশ্চয়তা নেই। তারা আবার এ ধরনের হত্যাকাণ্ড শুরু করতেই পারে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, এটা নির্ভর করে দেশের সরকার বা রাষ্ট্র কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার ওপর। অপরাধীদের ধরে শাস্তি নিশ্চিত করতে পারছে কিনা সেটা এখন দেখার বিষয়। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কিন্তু আমরা দেখছি না। অতএব এটা একটি ইতিবাচক দিক। বিলম্বে হলেও এটা আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি একটি রায়ের মাধ্যমে। তিনি বলেন, একটি মাত্র রায় এক্ষেত্রে যথেষ্ট না। এটা নির্ভর করে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। এক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে পারলে এ ধরনের অপরাধগুলো হয়তো বন্ধ হতে পারে।
সার্বিক বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন মানবজমিনকে বলেন, র্যাব কখনোই কাউকে ক্রসফায়ার করে না। অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক সময় গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসীরা যখন আমাদের উদ্দেশ্য করে গুলি করে এবং আমাদের কিছুই করার থাকে না তখন আমরাও গুলি করি। এসব গুলিতে অনেক সময় সন্ত্রাসীরা নিহত হয়। কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীরাও নিজেরা নিজেদের গুলিতে নিহত হয়। প্রতিটা ঘটনায় র্যাব সদস্যরাও আহত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পরে আড়াই মাস ধরে ক্রসফায়ারের কোনো ঘটনা ঘটেনি, তবে কি এই সময়ে অভিযান কমেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, র্যাবের অভিযানে গুলিবিনিময়ের ঘটনা না ঘটলেও অন্যান্য বাহিনীর অভিযানে হয়েছে। তবে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। অভিযানও কমে যায়নি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক সময় বলা হয় আমরা ক্রসফায়ার করি। কিন্তু ঘটনার পরে তদন্ত হয়। পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কথাটির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে একমত পোষণ করছি না। এটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড না। পেশাগত কাজ করতে গিয়ে অর্থাৎ কাজের প্রেক্ষিতে এটা ‘কিলড ইন অ্যাকশন’ (বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) হয়ে থাকে। এটা আদৌ কমেছে বা এটার পরিসংখ্যান কতটা আপনাদের কাছে আছে জানি না। তিনি বলেন, আমাদেরকে কাজের ক্ষেত্রে যদি কখনো কেউ রেসিস্ট (আঘাত) করে এবং সেখানে যদি আমরা কোনো একটি পর্যায়ে গিয়ে মনে হয় জীবন রক্ষার্থে কিছু করতে হয় সেক্ষেত্রে আমরা কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো নিয়ে থাকি। তার মানে এই নয়, এটার জন্য কোনো বাহিনীর উপর কোনো একটি দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
তিনি বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলো আদৌ সত্য নয়। এই ভাষাগুলো আমরা বিশ্বাস করি না। এ ছাড়া একটি অপারেশনে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে কোনো দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে নিজেকে রক্ষা করবো না- এটা আমি বিশ্বাস করি না। বন্দুক ব্যবহার করার অধিকার আমাকে দেয়া হয়েছে। কোনো একটি দেশ আমাকে নিষেধাজ্ঞা দিলেন কি দিলেন না তার জন্য আমার রেগুলার ডিউটি বন্ধ করে দেবো এটাতো হতে পারে না।