কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাটস্থ ঐতিহ্যবাহী বাঁকখালী নদী দখল ও প্যারাবন কেটে স্থাপনা নির্মাণকারী ২২ জনের নাম উল্লেখসহ ৪২ জনের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেছে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর। গত মঙ্গলবার রাতে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর থানায় মামলাটি করেন। পরে প্রাথমিক তদন্ত শেষে বুধবার সকালে মামলাটি রেকর্ড করে থানা পুলিশ।
এর আগে ২ ডিসেম্বর সাতজনের নাম উল্লেখ করে আরও একটি মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরের পর পর দুটি মামলার পরও থেমে নেই বাঁকখালী নদী দখল করে ভরাট, স্থাপনা নির্মাণ, প্যারাবন ধ্বংস, জোয়ারভাটায় বাঁধ দেওয়া ও জলাশয় ভরাট কার্যক্রম। পাশাপাশি রাতারাতি পাহাড়ি মাটি ফেলে নদী ভরাট করে চলছে দেদারছে স্থাপনা নির্মাণের কাজও।
সরেজমিন বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট অংশে গিয়ে নদী দখল, ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণের ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। গত চার মাস ধরে নদী দখল ও ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করা হলেও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করার কারণে দখলদাররা বেপরোয়া গতিতে অপরাধ অব্যাহত রেখেছে বলে জানান পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন।
তিনি বলেন, কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীতীরের প্যারাবন (ম্যানগ্রোভ) কেটে বসতবাড়ি ও অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধে দুই সচিবসহ ১২ সরকারি কর্মকর্তাকে জানুয়ারি মাসে বেলার আইনজীবী এস হাসানুল বান্নার স্বাক্ষরিত আইনি নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস)।
নোটিশ পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন— ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রধান বন সংরক্ষক, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক, কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এই নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়, বনভূমি ধ্বংস, গাছ কেটে জলাধার দখল ও ভরাট কার্যক্রম দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু তার পরও বাঁকখালী নদীসংলগ্ন এলাকায় এক রাতে ৮ একরের প্যারাবন দখল করে ৩০ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বন্ধ করা যায়নি নদী ভরাটসহ দেদারছে স্থাপনা তৈরির কাজ।
একইভাবে পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’-এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, নদী দখল এবং প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় জোয়ার-ভাটায় বাঁধ দিয়ে জলাশয় ভরাট ও প্যারাবন ধ্বংসের কর্মকাণ্ড গত চার মাস ধরে অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসন ও ভূমি প্রশাসন আজ পর্যন্ত কোনো উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেনি। এতে দখলদাররা অপরাধ কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হচ্ছে। বাঁকখালী নদী ও প্যারাবন রক্ষায় দ্রুত উচ্ছেদের দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, গত চার মাস ধরে বাঁকখালীতে নদী ও জলাশয় ভরাট, স্থাপনা নির্মাণ এবং প্যারাবন নিধন অব্যাহত রয়েছে। আমরা দুটি মামলা করেছি। কিন্তু উচ্ছেদের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট দরকার। আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে অনেকবার ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছি। কিন্তু গত চার মাসেও সহযোগিতা পাইনি। যে কারণে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া গেলেই উচ্ছেদ করা হবে। এদিকে বাঁকখালী নদী দখল ও প্যারাবন কর্তন করায় এজাহারে ২২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বুধবার সকালে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় পরিবেশ অধিদপ্তর বাদী হয়ে মামলা দিয়েছে।
মামলার আসামিরা হলো— যথাক্রমে মহেশখালী পৌরসভার, চরপাড়ার মো. ইউচুফ (৪৫), শহরের লালদীঘিপাড় এলাকার আশিক (৩৮), বদরমোকামের কফিল উদ্দিন, মিজানুর রহমান, বদরমোকামের মো. কামাল মাঝি ওরেফে কামাল মাঝি (৫০), মহেশখালীর কুতুবজোমের মেহেরিয়াপাড়ার রোকন উদ্দিন (৪০), নুরুল আবছার, নুরুল হুদা, শহরের বৈল্যাপাড়ার নুরুল আমিন, জসিম উদ্দিন, রামু চাকমারকুলের মোস্তফা কামাল (৫০), মহেশখালী পুটিবিলা এলাকার জাহেদুল ইসলাম শিবলু (৪০), কক্সবাজার সদর উপজেলার হাজিপাড়ার আমীর আলী (৪৫), ওমর ফারুক (৩৬) ওরফে দালাল ফারুক, সাতকানিয়া কাঞ্চনার শরিফুল আলম চৌধুরী (৫০), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনস্থ চাদগাঁও এলাকার মাহমুদুল করিম (৪১), খরুশকুল কুলিয়াপাড়ার মৃত মোহাম্মদ আলীর পুত্র মোহাম্মদ সোহেল (৩৬), সাতকানিয়া পশ্চিম ডলুর জসিম উদ্দিন (৪৪), বাঁশখালী চনুয়ার জিয়া মো. কলিম উল্লাহ (৪০), লোহাগাড়া চৌধুরীপাড়াস্থ উত্তর হরিয়া এলাকার খোরশেদ আলম চৌধুরী (৫৫), মনোহরগনজয়ের দক্ষিণ সরসপুর বাতাবাড়িয়া এলাকার ফিরোজ আহমদ ও দেলোয়ার হোসেন। এ ছাড়া অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ১৫ থেকে ২০ জন। পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও মামলার বাদী মো. সাইফুল জানান, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট প্যারাবন কর্তন এবং জলাশয় ভরাট করে দখল ও স্থাপনা নির্মাণ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।