সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় ঘটনার ১৮ মাসের মাথায় আজ ঘোষণা হতে যাচ্ছে। সোমবার (৩১ জানুয়ারি) ঘোষণা হবে এ রায়। এরই মধ্যে কক্সবাজার আদালত চত্বরে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত সৃষ্টির ৩৮ বছরের ইতিহাসে এ প্রথম এতো দ্রুত কোনো হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হবে।
এর আগে হত্যা কিংবা ফৌজদারি কোনো মামলায় এতো কম সময়ে অভিযোগপত্র গঠন, শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের নজির নেই। তেমনি নজির নেই এতো বিপুল সংখ্যক সাক্ষী নেওয়ার। সবকিছু যেন অবিশ্বাস্য গতিতেই এগিয়েছে। তাই সবার দৃষ্টি এখন এ রায়ের দিকে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সিনহা হত্যা মামলার রায়কে ঘিরে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেদিকে পুলিশের সর্বোচ্চ নজর রয়েছে। আদালতে নিরাপত্তার স্বার্থে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও বিপুল সংখ্যক পুলিশ থাকবে।
এদিকে সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস আশা করছেন, মামলার আসামি প্রদীপ ও লিয়াকতের সর্বোচ্চ সাজা হবে। আর বাকি আসামিদের সাজা যেন যার যার অপরাধের ভিত্তিতে হয় তা আশা করছেন তিনি।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, এ মামলায় ৮৩ সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আমরা সিনহা হত্যার বিষয়টি প্রমাণে সক্ষম হয়েছি। আশা করছি সর্বোচ্চ শাস্তি পাবেন ওসি প্রদীপ ও অভিযুক্তরা। স্বল্প সময়ে সিনহা হত্যার রায় দেশে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সূত্রমতে, প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) থাকাকালে মাদক নির্মূলের নামে ২২ মাসে ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার জন্ম দেন। তাতে মারা যান ২০৪ জন। নিহত সবাইকে দেওয়া হয় মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের তকমা।
তবে সাধারণ মানুষ বলছে, নিহতদের বেশির ভাগই ছিলেন নিরীহ। আর এমনই একটি সাজানো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। ঘটনাটি ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতের। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে এ ঘটনা ঘটে।
এরপর পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা করে। সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে এসব মামলা হয়। টেকনাফ থানায় দায়ের করা দুই মামলায় সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। আর রামু থানায় মাদক আইনে দায়ের করা মামলাটিতে আসামি করা হয় সিনহার অপর সফরসঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে। তবে পরবর্তীতে পুলিশের এই মামলা থেকে আদালত তাদের অব্যাহতি দেন।
এরপর ২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ (পরিদর্শক) লিয়াকত আলীকে।
আর টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, উপ-পরিদর্শক (এসআই) টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা।
মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভূক্ত করার পর আদালত তদন্তভার দেন র্যাবকে। একই সঙ্গে পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটিও র্যাবকে তদন্ত করার আদেশ দেন আদালত।
এরপর ২০২০ সালের ৭ আগস্ট মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় তিন বাসিন্দা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য ও ওসি প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরও সাতজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর গত বছরের (২০২১ সালের) ২৪ জুন মামলার অভিযোগভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের আদালতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে।
এ মামলায় চার মাসের বেশি সময় তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব-১৫ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি পরিকল্পিত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
মামলার ১৫ আসামি
বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্ত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ। এছাড়া রয়েছেন টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। এরা সবাই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।