বাংলাদেশ রেলওয়ে গেল অর্থবছরে (২০২০-২১) আয় করেছে ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যয় করতে হয়েছে ৬ হাজার ২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি এক টাকা আয় করতে রেল ব্যয় করেছে প্রায় ছয় টাকা। আগের দুই অর্থবছরের চিত্রও প্রায় অভিন্ন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা আয় করতে রেল ব্যয় করে ৫ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছরে ১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয় ৬ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। ৩ বছরে ৩ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা আয় হলেও ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ১৫ হাজার ১৪১ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে রেলকে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বে রেল সেবার সঙ্গে আয়ও করছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকসানের পাল্লা দিন দিন ভারী হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, উপরের কর্মকর্তা শুধু উন্নয়ন প্রকল্পের দিকে দৌড়াচ্ছে। সক্ষমতার দিতে তাকাচ্ছেন না। চলমান রেলপথকে সংস্কার না করে, বাহারি প্রকল্পের দিকে ধুঁকছে। সেবা নিশ্চিত করে, ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো যায়। জরাজীর্ণ ও সংস্কারহীন রেলপথ থাকলেই সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ সংস্কারহীন রেলপথ মানুষের প্রাণও কাড়ছে। যাত্রী ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ-মতামত নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করলে নিশ্চয়ই আয় বাড়বে। লোকসানের পাহাড় কমবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষতা বাড়িয়ে যাত্রীচাপ কাজে লাগিয়ে অনায়াসেই লোকসান কমিয়ে আনা সম্ভব। অপরিকল্পিত এবং সুদূর প্রসারবিহীন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা, চলমান রেলপথ ও অবকাঠামোর যথাযথ ব্যবহার না করার কারণেই লোকসানের অঙ্ক বাড়ছে। লোভনীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যস্ত সবাই। ফলে বঞ্চিত হচ্ছেন যাত্রী, তারা পাচ্ছেন না কাঙ্ক্ষাত সেবা, বাড়ছে ঋণের বোঝা। সূত্র বলছে, চলমান নড়বড়ে রেলপথ, রেল ব্রিজ, ইঞ্জিন-কোচ ও সিগন্যাল ব্যবস্থা সক্রিয় করা গেলে রেলের গতি অনেক বাড়ানো যেত। কমিয়ে আনা সম্ভব লোকসানও। সেদিকে কারও নজর নেই। সবাই বড় বড় প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। বর্তমানে ২৫৯টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। মালবাহী ট্রেন চলছে ৩৮টি। প্রতিটি যাত্রীবাহী ট্রেন ন্যূনতম ১৬-২০টি কোচ নিয়ে চলার কথা। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ১০৪টি আন্তঃনগর ট্রেন গড়ে ৭-১৪টি বগি নিয়ে চলছে। শুধু চলমান আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতেই আরও প্রায় ৭৩০টি কোচ সংযুক্ত করা সম্ভব। এতে প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার যাত্রী বেশি পরিবহণ করা সম্ভব। এতে আন্তঃনগর ট্রেন থেকে দিনে ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত আয় করা যায়। বাকি ২৫৫টি মেইল, কমিউটার এবং লোকাল ট্রেন ৩-৭টি কোচ নিয়ে চলাচল করছে। এসব ট্রেনে গড়ে ৬টি করে কোচ সংযুক্ত করলে ১৫৩৯টি অতিরিক্ত কোচ সংযুক্ত করা যায়।
কথা হয় রেলের সাবেক এক মহাপরিচালকের সঙ্গে। এ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, চলমান রেলপথ শুধু নয়, রেলওয়ে ব্রিজ, ইঞ্জিন-কোচসহ সিগন্যাল ব্যবস্থাও নড়েবড়ে। এসবের অধিকাংশরই আয়ুষ্কাল শেষ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এসবে গুরুত্ব না দিয়ে নতুন নতুন প্রকল্পে গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে। সমাপ্ত প্রকল্পের কোনো সুফল মিলছে না। খরচ বাড়লেও আয় বাড়ছে না। তিনি বলেন, বেসরকারি পর্যায়ে ট্রেন দেওয়া হলে আয় বাড়ত। অর্থাৎ সরকারের চলমান ট্রেনের সঙ্গে আরও বহু ট্রেন চালানো সম্ভব ছিল। বর্তমানে প্রায় ২৫ হাজার লোকবল স্বল্পতা রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে ট্রেন চালানো হলে-লোকবলও বেসরকারি পর্যায়ে নিয়োগ হতো। এতে সেবা বৃদ্ধির সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ত আয়ও।
রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে লোকসান বলে কিছু নেই। আমরাই রেলকে বিশ্ব উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। নিশ্চয়ই সেবার সঙ্গে আয়ও বাড়বে। বর্তমান সরকার যে ধারায় উন্নয়ন অব্যাহত রেখেছে-প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হলে আমূল পরিবর্তন আসবে। যাত্রীসেবা বৃদ্ধি এবং সমগ্র জেলায় রেলওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা আমাদের লক্ষ্য।
পরিবহণ ও মেকানিক্যাল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, রেলের উন্নয়নে বর্তমান সরকার আমূল পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে। বরাদ্দ বাড়ানোর সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু রেলপথ ঝুঁকি থেকে বের হতে পারছে না। বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়া ৩০ বছরের মাস্টারপ্ল্যানে (২০১৫-২০৪৫) সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে।
রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্র্তা জানান, কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের সঙ্গে নামেমাত্র ইঞ্জিন ও কোচ সংগ্রহে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কোচ-ইঞ্জিন ক্রয়ে প্রাধান্য না দিয়ে নতুন রেলপথ, ভবন নির্মাণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চাহিদার আলোকে কোচ-ইঞ্জিন ক্রয় এবং চলমান রেলপথের সংস্কার করে এ রেলপথেই প্রায় দ্বিগুণ ট্রেন চালানো সম্ভব। এখনো রেলের প্রায় ৬ হাজার একর জমি বেদখলে রয়েছে। জমি উদ্ধার করে তা কাজে লাগিয়ে এবং কোচ সংযুক্ত করে আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব অনায়াসেই।
কমলাপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহী রেল স্টেশন সূত্রে জানা যায়, রেলে লাগাতার লোকসানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা। করোনায় ট্রেন চলাচল বন্ধসহ অর্ধেক যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলায় প্রতিদিন প্রায় দেড় কোটি টাকা আয় কম হচ্ছে। একাধিক স্টেশন ম্যানেজার জানান, মূলত কোনো ট্রেনই খালি সিট নিয়ে চলাচল করে না। ট্রেনগুলোতে চোখ রাখলেই উপচে পড়া ভিড় চোখে পড়ে। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় জোগান কম।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী যুগান্তরকে জানান, রেল সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে রেল পরিচালনায় লাভজনক হলো কি হলো না, সেটা বাংলাদেশের জন্য মুখ্য নয়। তবে আমরা চেষ্টা করছি ট্রেন, কোচ বাড়িয়ে আয় বাড়াতে। এটাও ঠিক যে, বিশ্বে লাভজনক রেল ব্যবস্থাপনায় যাত্রীবাহী ট্রেনের চেয়ে মালবাহী ট্রেন বিশেষ ভূমিকা রাখছে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হলে এবং মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ট্রেনের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হবে। এ দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, চলমান ট্রেনগুলোতে অন্তত ৩ থেকে ৭টি করে কোচ সংযুক্ত করা যেতে পারে। কেন করা হচ্ছে না, সড়ক কিংবা বিমান মালিক- পরিবহণ নেতাদের সঙ্গে অনৈতিক কোনো আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে কিনা, সেটা খুঁজে দেখা উচিত।
এদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ট্রেন চালানো ও বিরতি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে অনেক। কম গুরুত্বের পথেও আসন সংখ্যা খালি রেখেই একাধিক ট্রেন চালানো হচ্ছে। অথচ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পথেও ট্রেন বাড়ানো হচ্ছে না। যেমন ঢাকা থেকে চিলাহাটি দেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম রেলরুটে দিনে মাত্র ১টি ট্রেন (নীলসাগর এক্সপ্রেস) রয়েছে। এ পথে যাত্রী চাহিদা যুগের পর যুগ থাকলেও নতুন ট্রেন দেওয়া হচ্ছে না। যাত্রীদের অভিযোগ, নীলসাগর এক্সপ্রেসে যত আসন তা চাহিদার এক-তৃতীয়াংশও নয়। ফলে আসনের দ্বিগুণের বেশি যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি চলাচল করে, কিন্তু অতিরিক্ত যাত্রীর (বিনা টিকিট) টাকা বলতে গেলে রেল পায় না। এর ওপর সম্প্রতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুটি বগি ওয়ার্কশপে পাঠানোয় এর পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে।
রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে রেলে শুধু লাইন সংস্কার নিশ্চিত করে আরও প্রায় ১০০টি ট্রেন চালানো সম্ভব। এ দুঅঞ্চলে এখনো গড়ে ২ ঘণ্টা পরপর ট্রেন চলাচল করছে। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন জানান, রেলে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। যতটুকু বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়েই চলমান রেলপথ সংস্কার করা হচ্ছে। তবে অধিকাংশ রেলপথেই যথাযথ পাথর স্বল্পতা রয়েছে। লাইনও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। লাইন শক্তিশালী হলে অল্প সময় পরপর ট্রেন চালানো সম্ভব।
পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজী জানান, পশ্চিমাঞ্চলেও লাইন সংস্কারে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। আমরা মাঠপর্যায় থেকে বরাদ্দ বিষয়ক চাহিদা রেলপথ বিভাগে পাঠাই, পরে যে সংখ্যক বরাদ্দ আসে তা দিয়েই কাজ করতে হয়। পুরো রেলপথ সংস্কারে আমরা কাজ করছি। জরাজীর্ণ লাইন সংস্কার করা হচ্ছে। পুরোনো লাইন তুলে ডুয়েলগেজ লাইনে রূপান্তর করা হচ্ছে। এতে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো যাবে। কোচ সংযুক্ত করে ট্রেন পরিচালনা করা যাবে। বাড়বে আয়ও।