১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর। সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশে উদ্বোধন করা হয় সর্বোচ্চ আদালত। আর উদ্বোধন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০১৮ সাল থেকে ‘সুপ্রিম কোর্ট দিবস’ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেদিন বিচারপতি ও আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বক্তব্য রাখেন। পরদিন দেশের জাতীয় দৈনিকগুলো প্রথম পাতায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
১৯৭২ সালের ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলায় ‘আইনের শাসন কায়েমে সহায়তা করুন’ শীর্ষক শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করা হবে না’ শিরোনামে দৈনিক আজাদে প্রতিবেন প্রকাশিত হয়। আর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘সরকার আইনের শাসনে বিশ্বাসী’ এবং পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবেই’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সম্প্রতি ‘বঙ্গবন্ধু ও সুপ্রিম কোর্ট’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচরপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। ওই প্রবন্ধে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ছিল সরকারি ছুটি। কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওই দিন ছুটি প্রত্যাহার করে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের ‘দৈনিক কার্য তালিকা’ (কজ লিস্ট) প্রণয়ন করেন এবং ওই তারিখ থেকে সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়।
১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে। ভাষণ দিয়েছিলেন সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি, আইনজীবীসহ উপস্থিত সুধীবৃন্দের উদ্দেশ্যে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম। বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমাদের সুপ্রিমকোর্ট, আজ আমাদের দেশে আইনের শাসন হতে চলেছে, তাদের আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন। ’বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, আমি নিশ্চয়ই সুখি হতাম, যেমন পিজি হসপিটালে গিয়ে দেখি যে, এতজন ডাক্তারের নাম, যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের নাম লেখে ফলক করে রাখা হয়েছে। আমি সুখি হতাম বারের সদস্য ভাইয়েরা, যে যে সহকর্মীরা যারা শহীদ হয়েছেন- এই সুপ্রিম কোর্টের গেটে এসে দেখতে পেতাম যে শহীদের নাম সেখানে লেখা রয়েছে। বেয়াদবি মাফ করবেন, আপনাদের আমি অভিযোগ করছি না।
আইনের শাসন নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-আইনের শাসনে আমরা বিশ্বাস করি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আমরা অনেক সংগ্রাম করেছি এবং এই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনেক মানুষের রক্ত দিতে হয়েছে। বাংলাদেশে আইনের শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে। সেজন্যই শাসনতন্ত্র এত তাড়াতাড়ি দিয়েছিলাম। যদি ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা, যদি রাজনীতি করতাম আপনারা নিশ্চয়ই আমার পাশে যারা বসে আছেন জানেন যে, তালে তাল মিলিয়ে- গালে গাল মিলিয়ে বহুকাল ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। কিন্তু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই, রাজনীতি করেছিলাম মানুষের মুক্তির জন্য। সে মানুষের মুক্তি মিথ্যা হয়ে যাবে, যদি মানুষ তার শাসনতন্ত্র না পায়। আইনের শাসন না পায়।
… আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। আপনারা আইনের শাসন পরিচালনা করবেন।
সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, আইনের মধ্যে যদি গোলমাল হয়, সেখানে আপনাদের সংশোধন করার ক্ষমতা রয়েছে। মনে করেন তাতে পরিপূর্ণতা হচ্ছে না- আপনাদের ক্ষমতা রয়েছে নতুন আইন পাশ করা। এমন আইন পাশ করা উচিত হবে না দেশের মধ্যে রেষারেষি সৃষ্টি হয়।
বিচারপতি-আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, আমি আইনজীবী নই, আপনারা আইনজীবী, আপনারা বুদ্ধিজীবী, আপনারা ভালো বুঝেন। আমি আইনজীবী কোনোদিন হতে পারি নাই, তবে আসামি হওয়ার সৌভাগ্য আমার যথেষ্ট হয়েছে জীবনে। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে দেশের শাসনতন্ত্রকে যাতে উপযুক্ত ব্যবহার করা হয়, সেদিকে আপনারা নজর রাখবেন। কারণ সে ক্ষমতা শাসনতন্ত্রে আপনাদের দেওয়া হয়েছে। যে আইন শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে হবে তার সম্পর্কে মতামত দেওয়ার অধিকার আপনাদের আছে, নাকচ করার অধিকার আপনাদের রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে যায়। সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমি আপনাদের অ্যাডভাইজ দিতে চাইনা, আপনারা এ জিনিসটা আমার চেয়ে অনেক ভাল বুঝেন। বিচার বিভাগ নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আপনাদের কোনো কাজে আমরা ইন্টারফেয়ার করতে চাই না। আমরা চাই যে, দেশে আইনের শাসন কায়েম হউক।