নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নিয়ে আইন প্রণয়ন, নির্বাচনে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোসহ চার প্রস্তাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল বিকালে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে এসব প্রস্তাব দেন। ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান সংলাপের শেষ ভাগে ১৭তম দিনে বঙ্গভবনের দরবার হলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হলো। পরে দলটির কার্যালয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বৈঠকে রাষ্ট্রপতির কাছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছু প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এতে ইসি শক্তিশালীকরণ, আইন প্রণয়ন, নির্বাচনে আরও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগের বিষয়েও কয়েকটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তাদের নিয়োগের জন্য একটি আইন প্রয়োজন বলেও মনে করে আওয়ামী লীগ।
এর আগে বিকাল ৩টা ৫৫ মিনিটে প্রতিনিধি দল নিয়ে বঙ্গভবনে পৌঁছান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫টা ১০ মিনিটে বৈঠক শেষে বের হন তারা। আওয়ামী লীগের ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান। আওয়ামী লীগের চার প্রস্তাবে যা আছে প্র্র্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট চারটি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে- প্রথমত: সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮-এর বিধান অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগদান করবেন।
দ্বিতীয়ত: প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যেরূপ উপযুক্ত বিবেচনা করবেন, সেই প্রক্রিয়ায় তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দান করবেন। তৃতীয়ত: প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮-এর বিধান সাপেক্ষে একটি উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। বর্তমানে এই ধরনের কোনো আইন না থাকায় সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারগণের নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধান ব্যতিরেকে অন্য কোনো আইন প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সাংবিধানিক চেতনা সমুন্নত রাখতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারগণের যোগ্যতা-অযোগ্যতা এবং তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নির্ধারণের লক্ষ্যেই মূলত এই আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে যেকোনো আইন হবে সাংবিধানিক বিধান মতে- একটি বিশেষ ধরনের আইন। এই বিশেষ ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো সুনির্দিষ্ট উদাহরণ ছিল না।
নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে একটি রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে একমাত্র আওয়ামী লীগ একটি সাংবিধানিক রীতি ও রাজনৈতিক অনুশীলন প্রতিষ্ঠা করেছে। এই সাংবিধানিক রীতিটি হলো ‘সার্চ কমিটি’/‘অনুসন্ধান কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে সকলের মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন। এই ব্যবস্থাটি এখন পর্যন্ত দুই বার (২০১২ এবং ২০১৭) অনুশীলন করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। দুই বারই দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই অনুশীলনে অংশগ্রহণ করেছে। এমতাবস্থায়, এই রীতিটির আলোকে এবং এই প্রক্রিয়ালব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের আলোকে একটি আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। চতুর্থত: সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে সকল নির্বাচনে অধিকতর তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ও জনমানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ এদিকে বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন।
এ সময় তিনি বলেন, বৈঠকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মাননীয় সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে ‘‘গণতন্ত্র ও নির্বাচন: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ” শিরোনামে দলের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রস্তাবনায় নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ, নির্বাচন কমিশনের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন ও সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব ও সুপারিশ উপস্থাপন করা হয় এবং এই ধরনের অর্থবহ সংলাপ আহ্বানের মধ্য দিয়ে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করায় মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সুগভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুবিবেচনার প্রতি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গৃহীত যেকোনো ন্যায়সঙ্গত উদ্যোগের প্রতি আমাদের পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত মূল বিধানাবলী দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানেই (অনুচ্ছেদ ১১৮-১২৬) উল্লেখ রয়েছে। লিখিত বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র ও জনমানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণে যা কিছু হয়েছে তা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনকালে (২০০১-২০০৬) নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল এবং মহাজোটের অন্যান্য শরিকদল নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে একটি অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করে।
এই রূপরেখায় নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা এবং নির্বাচনী আইন ও বিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে মোট ২৩-দফা সুপারিশ করা হয়। প্রস্তাবসমূহের প্রতি দেশপ্রেমিক সকল নাগরিক ও সুশীল সমাজ অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল কর্তৃক উপস্থাপিত দাবিসমূহের প্রতি কোনোরূপ ভ্রূক্ষেপই করেননি। কারণ তারা জানতেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। জনরোষের মুখে ২০০৬ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে বিএনপি-জামায়াত জোটের এই অনীহা অব্যাহত থাকে। ওবায়দুল কাদের বলেন, ২০০৭ সালের ১/১১-তে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রবল জনমতের চাপে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে ১৪ দল উপস্থাপিত দাবিসমূহকে সক্রিয় বিবেচনায় নেয়া হয়। এই দাবি অনুসারে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, নির্বাচনে পেশীশক্তি ও অর্থের ব্যবহার বন্ধ, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ইচ্ছুক প্রার্থীর সম্পদের বিবরণী প্রকাশ, চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরপরই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ বন্ধ করা, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে সম্ভাব্য জনপ্রতিনিধির তালিকা প্রণয়ন এবং সেখান থেকে মনোনয়ন প্রদান, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্য থেকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার নিয়োগসহ যে যে প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচন কলুষিত হতে পারে তা বন্ধে সে বিষয়ে পদ্ধতিগত সংস্কারের রূপরেখা প্রদান করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যায় নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করে। একই সঙ্গে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক বারবার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত থেকে নির্বাচন প্রতিহত করার নামে দেশব্যাপী এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মেতে ওঠে। গণপরিবহনে অগ্নিসন্ত্রাসের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে নজিরবিহীন ত্রাসের সৃষ্টি করে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সন্ত্রাসীদের নির্বিচার আক্রমণে ২৩ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতাকর্মী এবং অনেক সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। তবে দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ বিএনপি-জামায়াত জোটের নৃশংসতম এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে ২০১৮ সালেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু বিএনপি ও তাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো দুরভিসন্ধি নিয়ে সংলাপে অংশগ্রহণ করে নির্বাচনের পূর্বেই নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্টের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। নির্বাচনের পূর্বে ও পরে বিএনপি নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।