ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন-উত্তর ও দক্ষিণের পরিবহণ বিভাগ। গাড়ি ক্রয়, বরাদ্দ, ব্যবহার ও জ্বালানি খরচে প্রায় নির্বিঘ্নে চলছে এসব অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা। অধিকাংশ পরিবহণ চালক ও সংস্থা দুটির শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় দীর্ঘদিনের এই অনিয়মের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
আরও জানা যায়, করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে স্বাস্থ্য খাতে টিকা ক্রয়ে বিপুল অর্থ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এজন্য ২০২০ সালের জুন মাসে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি খাতে গাড়ি ক্রয় বন্ধ করা হয়। সরকারি এ অনুশাসন মেনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে ২৫ কোটি টাকার গাড়ি ক্রয়ের বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতে দেওয়া হয়েছে। অথচ দুই সিটিতে প্রাপ্যতার চেয়ে ৬ গুণ বেশি গাড়ি থাকলেও নতুন করে গাড়ি কেনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ৫টি জিপ ও ৫টি পিকআপ ক্রয় করেছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) নতুন প্রাধিকারবহির্ভূত কয়েকজন কর্মকর্তার জন্য গাড়ি কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘৩০ বছর আগের প্রাধিকার তালিকা দিয়ে এখন কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়। এজন্য আমরা নতুন করে প্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন করার চিন্তাভাবনা করছি।’ এছাড়া অন্যান্য অনিয়ম বন্ধের ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষ তৎপর রয়েছে। কোনো অনিয়ম পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘ডিসিসি বিভক্তির পর নতুন করে প্রাধিকার তালিকা করা হয়নি। এজন্য বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। আমরা নতুন প্রাধিকার তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটা চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুর্নীতি ও অনিয়ম পেলে কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। পরিবহণ বিভাগের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
প্রাধিকার তালিকা : ১৯৯০ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) গাড়ির প্রাধিকার তালিকা করে দেওয়া হয়। ওই তালিকা অনুযায়ী ডিসিসির অনুমোদিত যানবাহনের সংখ্যা ৩৫৯টি। এর মধ্যে কার, জিপ, পিকআপ ও মাইক্রোবাসের সংখ্যা ৩৭টি। ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকার রয়েছে সর্বোচ্চ ২০ জনের। ১৩টি কার, ১৮টি জিপ, ৩টি পিকআপ এবং ৩টি মাইক্রোবাস তারা পাবেন। আর ২টি বাসে স্টাফদের কোয়ার্টার থেকে যাতায়াতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য কার (গাড়ি) পাবেন মেয়র বা প্রশাসক ১টি। ভিআইপিদের জন্য রিজার্ভ থাকবে ১টি। অফিসিয়াল ব্যবহারের জন্য গাড়ি পাবেন- প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ১টি, প্রধান প্রকৌশলী ১টি, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ১টি, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরা ১টি করে এবং প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ১টি। এছাড়া মেয়রের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, জনসংযোগ কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, সহকারী ব্যক্তিগত কর্মকর্তা যৌথভাবে একটি গাড়ি ব্যবহার করবেন। অফিসের কাজে ব্যবহৃত হবে ২টি এবং জরুরি কাজের জন্য বরাদ্দ থাকবে ১টি। এছাড়া ১৮ জিপ ব্যবহার করবেন ১৩ জন প্রকৌশলী, তারা অফিসিয়াল কাজে ১টি করে জিপ পাবেন। এছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় ১টি করে গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। স্বাস্থ্য ও মশক নিয়ন্ত্রণ কাজে ১টি গাড়ি, ২টি গাড়ি অন্যান্য অফিসিয়াল কাজে ব্যবহার হবে এবং ১টি গাড়ি জরুরি প্রয়োজনে বরাদ্দ থাকবে। এর বাইরে অনুমোদিত গাড়ির প্রাধিকার তালিকায় ৩টি পিকআপ, ৩টি মাইক্রোবাস, ২টি বাস ও ৭৯ মোটরসাইকেল, ৭৮টি দেড় টন ট্রাক, ১৪৭টি ৫ টন ট্রাক, ৫টি ওয়াটার ট্রাঙ্ক, ১০টি হাইড্রোলিক লেডার ও ১টি ট্রাক্টর রয়েছে।
দুই সিটির বর্তমান চিত্র : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) গাড়ি রয়েছে ৪২৩টি। এর মধ্যে কার, জিপ, পিকআপ ও মাইক্রোবাসের সংখ্যা ৭৬টি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গাড়ির সংখ্যা ৬০৯টি। এর মধ্যে কার, জিপ, পিকআপ ও মাইক্রোবাসের সংখ্যা ৮৩টি। ডিসিসির প্রাধিকার তালিকা অনুযায়ী ২০ জন কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক ও অফিসের কাজে ব্যক্তিগতভাবে গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। আর গাড়ির প্রাপ্যতা রয়েছে ৩৪টি। গাড়ির প্রাধিকারের অনুমোদন ছাড়াই ১৫৯টি গাড়ি ব্যবহার করছেন। স্বায়ত্তশাসিত একটি সংস্থা হিসাবে এ ধরনের কার্যক্রম অবৈধ। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটা বড় প্রতিবন্ধক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অবৈধ গাড়ি বিলাস : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ। সরকারের অতিরিক্ত সচিব। সরকারি ঋণে গাড়ি কিনেছেন। এরপরও নিজে দুটি পাজেরো স্পোর্টস জিপ ব্যবহার করছেন। একটি অফিসের কাজে এবং অন্যটি বাসায়। গত সেপ্টেম্বর মাসের তেল বিলের হিসাব পর্যালোচনা করেছেন এ দুটি জিপ পরিচালনায় তিনি ১ হাজার ৬৩০ লিটার জ্বালানি ব্যবহার করেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মাসে গাড়িপ্রতি জ্বালানির প্রাপ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ ২০০ লিটার। সংস্থার একজন শীর্ষ কর্মকর্তার এমন আচরণের কারণে অন্যরা গাড়িবিলাসে উৎসাহী হচ্ছেন-এমন অভিযোগ সশ্লিষ্টদের। তার ব্যবহৃত দুটি গাড়ির নম্বর ১৮-০২০৭ এবং ১৫-৫১৬৪। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফরিদ আহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, ‘পদ অনুযায়ী আমার সার্বক্ষণিক ডিউটি। এজন্য দুটি গাড়ি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কেননা একজন চালক ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে পারে না।’ তবে পারিবারিক কাজে ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।
এ দৌড়ে পিছিয়ে নেই ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজাও। সরকারি ঋণে গাড়ি কিনেছেন তিনি। এরপরও ডিএনসিসি থেকে একটি জিপ ব্যবহার করছেন। তার ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর ১৭-৫৩৭৮। আরও একটি মাইক্রোবাস তার দপ্তরে জরুরি কাজের জন্য নিয়োজিত রাখা হয়েছে। ওই গাড়ির নম্বর ৭১-০৪৩১। এ গাড়ি তার বাসায়ও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ মিলেছে। এ প্রসঙ্গে সোমবার টেলিফোনে জানতে চাইলে সেলিম রেজা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি একদিন অফিসে আসেন আপনাকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলব।’
শুধু দুই সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নন, রয়েছেন প্রকৌশলী ও অন্য কর্মকর্তারাও। ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী মুহাম্মদ আমিরুল ইসলাম। সরকারি ঋণে তিনি গাড়ি কিনেছেন। এরপরও ডিএনসিসির পরিবহণ বিভাগ থেকে তিনি দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। গাড়ির নম্বর-১৭-৫৩৭৯ ও ১২-০৩৯৫। একটি তিনি নিজে ব্যবহার করছেন। অন্যটি তার পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করছেন।
ডিএসসিসির যান্ত্রিক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আনিছুর রহমান। প্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তা হিসাবে তিনি একটি গাড়ি ব্যবহার করেন। এতদিন তিনি টয়োটা জিপ ১৮-৫৪০১ ব্যবহার করতেন। কিন্তু করোনা দুর্যোগের মধ্যেও তার জন্য ক্রয় করা হয়েছে লেটেস্ট মডেলের পাজেরো জিপ। গাড়ি নম্বর-২১-২১৩০। ডিএসসিসির স্থপতি ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. সিরাজুল ইসলাম প্রাধিকারপ্রাপ্ত না হয়েও তিনি ব্যবহার করছেন পাজেরো স্পোটস জিপ-১৪-২২৬৯। এছাড়া তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আরবান নেইবার হুড প্রকল্পের আওতায় ক্রয় করা ৫টি কার। এগুলো বিভিন্ন সময় ব্যক্তিগত কাজে তিনি ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা অধীনস্থ দপ্তর বা বিভাগের গাড়ি ব্যবহার করতে পারবে না। এরপরও দুই সিটি করপোরেশনের ৩টি গাড়ি স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য রাখা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই তিনটি গাড়ির একটির (১৮-৫৪০২) জন্য ডিএসসিসির গত সেপ্টেম্বর মাসের জ্বালানি খরচের হিসাবে দেখানো হয়েছে ৬০০ লিটার। একই মাসের হিসাবে আরও দেখানো হয়েছে ৩২-৬৮৫৪ নম্বরের কারটি স্থানীয় সরকার বিভাগের এক যুগ্মসচিব ব্যবহার করছেন। ওই মাসের জ্বালানি খরচ দেখানো হয়েছে ৪৫০ লিটার। গত সেপ্টেম্বরে ডিএনসিসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অধিকারের আবেদনের জবাবে বলা হয়, ১৩-২০৫৭ নম্বর কারটি স্থানীয় সরকার বিভাগে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রাধিকার তালিকা অনুযায়ী দুই সিটির সচিবেরও প্রাধিকার প্রাপ্যতা নেই। কিন্তু তারা গাড়ি ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে তারা সরকারি ঋণে গাড়িও ক্রয় করেছেন। ডিএসসিসি সচিব আকরামুজ্জামানের ব্যবহৃত জিপের নম্বর ১৮-০২০৫। ডিএনসিসি সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক। তার ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর ১৭-৫২৭০। এছাড়া তার দপ্তরে ৫৩৬৬৫৭ নম্বরের মাইক্রোবাসটি জরুরি কাজে নিয়োজিত রাখা হয়েছে। এ গাড়িটিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুই সিটির পরিবহণ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মহাব্যবস্থাপক, প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা, মেয়রের এপিএস, পিও, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্টাফ অফিসারসহ প্রেষণে আসা বেশির ভাগ কর্মকর্তা অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহার করছেন। সরকারি ঋণে গাড়ি কিনেও তারা অবৈধভাবে সিটি করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করছেন। এসব দেখার কেউ নেই-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, এসব দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই সিটির রক্ষকরাই ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। এ কারণে সবাই মিলেমিশে গাড়িবিলাস ও অবৈধভাবে জ্বালানি ব্যবহারে মেতে উঠেছেন তারা।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গাড়ির প্রাধিকার হালনাগাদ না করে যথেচ্ছ গাড়ি ব্যবহার অগ্রহণযোগ্য। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সংস্থা হিসাবে ঢাকার দুই সিটির গাড়ির প্রাপ্যতা সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে। গাড়ি বরাদ্দ ও ব্যবহারের নীতিমালা চূড়ান্ত করতে হবে। দীর্ঘদিন সেটা না করে গাড়ি ক্রয় করে ফেলা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। দুই সিটিতে এ ব্যাপারে যেটা করা হয়েছে সেটাতে মনে হচ্ছে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে এসব হচ্ছে। এসব বন্ধে দুই মেয়রকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সরকারি অর্থের অপচয় ঘটতেই থাকবে।