সীমাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে দেশের ৬০ ব্যাংকের মধ্যে ২৫টি ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৫টি ব্যাংক রয়েছে বড় ঝুঁকির মধ্যে। এদের খেলাপি ঋণের হার বেশি হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে মূলধন সংরক্ষণের হারও। কয়েকটি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতেও পড়েছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন খাতে আটকে রয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এর মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবেও কয়েকটি ব্যাংকের এলসি সরাসরি গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। তৃতীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি লাগছে। ফলে বাড়ছে ব্যবসা খরচ।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। যেসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে, সেগুলোর ঘাটতি পূরণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া ও আদালতে মামলার কারণে কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের ছোবল কমাতে হবে। তা না হলে ব্যাংকগুলো সাউন্ড হবে না। আন্তর্জাতিকভাবেও নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। ব্যবসায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ঋণের মান ভালো না হওয়ার কারণে খেলাপি বাড়ছে। মানসম্পন্ন ঋণ বিতরণ করতে হবে। এর জন্য দরকার সুশাসন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ। সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিকভাবে কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের বেশি থাকলে ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী এ হার ৫ শতাংশের বেশি থাকলে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ২০ দশমিক ০৭ শতাংশ রয়েছে সরকারি খাতের ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে। বেসরকারি খাতের ৪২টি ব্যাংকে রয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বিশেষায়িত তিনটি সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। গড়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। তবে ২টি ব্যাংকের মাত্রতিরিক্ত খেলাপি ঋণ রয়েছে। সব মিলে সরকারি খাতের ৯টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ। সরকারি খাতের ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সবকটিতেই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের বেশি। ৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ১৪টির ৫ শতাংশের ওপরে। ৯টি বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে ২টি ব্যাংকের এবং ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংকের সবকটিতে খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি খাতের নতুন প্রজন্মের চারটি ব্যাংককেও খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের ওপরে।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৫০ শতাংশের ওপরে খেলাপি ঋণ রয়েছে পাঁচটি ব্যাংকের। এগুলো হচ্ছে, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির অর্থ আদায় করতে পারছে না। যে কারণে কমছে না খেলাপি ঋণ। কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকেরও (সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংক) একই অবস্থা। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কার্যক্রমে চলছে স্থবিরতা।
এ প্রসঙ্গে সরকারি খাতের একটি ব্যাংকের এমডি বলেন, তিনটি সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকেই চারটি গ্রুপের কারণে খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হলমার্ক, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, অ্যানন টেক্স গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও বেসিক ব্যাংক। এদের কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকলে এত বড় ঋণ ব্যাংকের পক্ষে এককভাবে দেওয়া সম্ভব হতো না। আর এত ঋণখেলাপিও হতো না। এখন এসব ঋণ আদায়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইনের ভেতর দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। যে কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো ভুগছে।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক চাপে খেলাপি ঋণ কিনে কয়েকটি ব্যাংক নতুন ঋণ দিতে বাধ্য হয়েছে। ওইসব ঋণও এখন আদায় হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুব বেশি তদারকি করতে পারে না। নানা চাপে তাদের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের মালিকানাধীন দুটি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে হাবিব ব্যাংকের ১৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৯৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। সরকারি খাতের বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ১৯ দশমিক ২৯ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে।