হাসপাতালের বারান্দায় এদিক-ওদিক জটলা করে বসে আছেন স্বজনরা। শিশুদের বুকে আগলে রেখেছেন মা-খালারা। সবাই যেন শোকে স্তব্ধ। চুপিসারে কেঁদে চলেছেন কেউ কেউ। ডাক্তারের কাছে বারবার ধরনা দিচ্ছেন। তাদের প্রিয় মানুষটি আইসিইউ-এইচডিইউতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। স্বজনদের এ কান্না ছুঁয়ে যায় চিকিৎসক-নার্সদেরও। তারাও যেন বাকরুদ্ধ। শনিবার এমন চিত্র দেখা যায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিদগ্ধ ২১ জনকে এখানে আনা হয়েছিল।
বর্তমানে ভর্তি আছেন ১৫ জন। সবার অবস্থাই সংকটাপন্ন। বাকিদের মধ্যে হাবিব খান নামের একজন শুক্রবার রাতে মারা গেছেন। পাঁচজন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) বারান্দায় অন্তত ১০-১২ জন কওমি মাদ্রাসার নারী শিক্ষক প্রার্থনা করছিলেন। শিক্ষিকা হাফিজা আক্তার জানান, লাইফ সাপোর্টে থাকা মারুফা আক্তার (৪৮) ঢাকার চিটাগাং রোডে অবস্থিত মাদ্রাসায় (রাহিমা-আমিনা কওমি মাদ্রাসা) আয়ার কাজ করতেন।
মারুফার দুই মেয়ে, এক ছেলে। দুই মেয়ে ওই মাদ্রাসায় পড়ত। বৃহস্পতিবার দুই মেয়ে মার্জিয়া (১১) ও মাহিদাকে (১৫) নিয়ে ঢাকা থেকে ঝালকাঠি যাচ্ছিলেন তিনি। মেয়ে মার্জিয়া লঞ্চে আগুনে পুড়ে বর্তমানে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। মাহিদাকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায়। মারুফার স্বামী তাকে দেখাশোনা করেন না বলে জানান শিক্ষিকা হাফিজা আক্তার।
সপ্তম তলার আইসিইউর ৩ ও ৪ নম্বর বেডে ভর্তি আছেন জেসমিন আক্তার (৩৬) ও তার ছেলে তামিম হাসান (৫)। জেসমিন জানান, তার মেয়ে মাহিনুর মীম (৪) আগুনে পুড়ে মারা গেছে। শনিবার ভোরে তার গর্ভে থাকা ৬ মাস বয়সি মৃত সন্তান পেট কেটে বের করেন চিকিৎসকরা। তিনি আরও জানান, স্বামীকে নিয়ে বরগুনার শরিষামুড়িতে থাকেন তারা। স্বামী বরগুনা শহরে ভ্যানে পুরাতন কাপড় বিক্রি করেন। ১৩ ডিসেম্বর দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জে এসেছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে দুই সন্তান নিয়ে লঞ্চে বরগুনায় ফিরছিলেন তারা।
লঞ্চে আগুন লাগলে দুই সন্তানকে জড়িয়ে চিৎকার করছিলেন। লঞ্চ চরের কাছে আসার পর মেয়ে মীমকে বালুর মধ্যে ফেলে দেন। আর ছেলেকে নিয়ে নিজেও লাফ দেন। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এদিকে মায়ের পাশের বেডে শুয়ে থাকা ছোট্ট তামিম এখনও জানে না ছোট বোন মীম মারা গেছে। তার সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। চতুর্থ তলার আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন শাহিনুর খাতুন। বেডের পাশেই একটি চেয়ারে বসে আছেন একজন নার্স। ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক প্রফেসর রেহেনা আউয়াল সুমি বলেন, লাইফ সাপোর্ট মানেই চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থা।
যে কোনো সময় তাদের মৃত্যু হতে পারে। শাহিনুর খাতুন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। ৫ম তলায় এইচডিইউতে ভর্তি আছেন তার (শাহিনুর) স্বামী বাচ্চু মিয়া (৫১) ও মেয়ে ইশরাত জাহান (২২)। দুজনেরই সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। বাচ্চু মিয়া জানান-ছেলেমেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে তিনি কেরানীগঞ্জে থাকেন। তার ফার্মেসি রয়েছে। মেয়ে ইশরাত, ছেলে সাদিক ও স্ত্রী শাহিনুরকে নিয়ে ৪ বছর পর গ্রামের বাড়ি বরগুনায় যাচ্ছিলেন তারা। লঞ্চে আগুন লাগলে অন্ধকারে একে অন্যকে হারিয়ে ফেলেন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় বরিশাল থেকে এখানে আনা হয় তাদের। পাশের দুটি বেডের পরে শুয়ে আছে মেয়ে ইশরাত জাহান। তার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। ছেলে সাদিক আহত হয়েছিল। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এইচডিইউতে কাতরাচ্ছেন প্রাবসী সেলিম রেজা। বেডের ওপর বসে জাহানারা-জাহানারা বলে ডাকছিলেন তিনি। ডাক্তার, নার্সরাও তাকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না। চিৎকার করে বলছিলেন, তার স্ত্রী জাহানারাকে যেন এনে দেওয়া হয় কিংবা তাকে যেন হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এখনও তার স্ত্রীর খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ প্রতিবেদক কাছে যেতেই সেলিম রেজা বলেন, ‘আমার বউয়ের কি কোনো খবর পাইছেন? মিথ্যা কথা বলবেন না, আমার বউ কোথায় আছেন বলেন, প্লিজ।’ সেলিম রেজা জানান, তিনি ১৮ বছর ধরে সৌদি আরবে ছিলেন। বিয়ে করেছেন ১১ বছর। স্ত্রী জাহানারা বেগম পটুয়াখালী উত্তর শ্রীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন যুগান্তরকে বলেন, আগুনে পোড়া রোগীদের সঙ্গে স্বজনদের রাখা বিপজ্জনক। বিশেষ করে যাদের শ্বাসনালি ও শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এসব রোগীর দ্রুত ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে ভর্তি ১৫ জনই সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। আমরা সাধ্যমতো চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি।