দলীয় শৃঙ্খলা ফেরাতে হার্ডলাইনে বিএনপি। শনিবার কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) পদ থেকে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে অব্যাহতি দেওয়ার মাধ্যমে তৃণমূলকে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রভাবশালী এই নেতার বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কী- তা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও দেখা গেছে কৌতূহল। তবে দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান, সম্প্রতি খুলনা জেলা ও মহানগর শাখার কমিটি ঘোষণার পর মঞ্জুর কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। দায়িত্বশীল পদে থেকে ওই কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি মূলত হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। ব্যবস্থা নেওয়া না হলে দল পুনর্গঠনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত।
দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শনিবার বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, নজরুল ইসলামকে অব্যাহতি দিয়ে খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। চিঠি দিয়ে এ সিদ্ধান্তের কথা তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দলীয় সূত্র জানায়, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেওয়া কমিটির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে সংবাদ সম্মেলন করায় মঞ্জুকে ১৩ ডিসেম্বর শোকজ করা হয়। তিন দিনের মধ্যে তিনি শোকজের জবাব দেন। ৫ পৃষ্ঠার জবাবেও সত্য গোপন করে ভুল তথ্য দিয়ে অযোগ্য লোকদের নেতৃত্বে বসানোর কথা উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে যোগ্য ও ত্যাগীদের দিয়ে কমিটি পুনর্গঠনের অনুরোধ জানান। তার ওই জবাবে হাইকমান্ড সন্তুষ্ট না হওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা কেউ কথা বলতে রাজি হননি। দলটির একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, দলের হাইকমান্ডকে চ্যালেঞ্জ করে সংবাদ সম্মেলন করার বিষয়টি ভুল স্বীকার করে আবেদন করলে বিবেচনা করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে অব্যাহতি প্রত্যাহারও করতে পারেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে দল আমার প্রতি অবিচার করেছে। অগ্রহণযোগ্য নেতাদের নিয়ে কমিটি দেওয়া হয়েছে আমি সেটি ছোট আকারে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলাম। আমি তো অসত্য কিছু বলিনি। দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এবং যারা অসৎ উদ্দেশ্যে দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে নিজেদের মতো করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে বলেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে জিয়াউর রহমানের দল সততা, নিষ্ঠা ও ভালো মানুষের দল হবে- একথাগুলোই বলেছি। আমার নিজের জন্য বা দলের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলিনি। হাইকমান্ডের বিরুদ্ধেও কোনো কিছু বলিনি। সত্য গোপন করে ভুল তথ্য দিয়ে অযোগ্য লোকদের নেতৃত্বে বসানোর প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বলেছি।
এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, কোথায় যাব। আমি বিএনপির লোক, এই দলেই থাকব। বিএনপির কর্মী আমি। দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে বিএনপি করি। জিয়াউর রহমানের আদর্শে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ও বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে রাজনীতি করি। দলের এই দুঃসময়ে দল যেন সঠিক পথে থাকে, সঠিক ধারায় থাকে সেটাই চাই। কখনও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিনি। দলের সব কর্মসূচি সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছি। খুলনায় সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সাহসী পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি।
৯ ডিসেম্বর খুলনা মহানগর ও জেলা শাখা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়। এ কমিটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র মনিরুজ্জামান মনি বাদ পড়েন। নতুন কমিটিতে তাদের কোনো অনুসারীকেও রাখা হয়নি। এ ঘটনায় সেখানে নেতাকর্মীদের একটি অংশের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে কমিটি ঘোষণার দুই দিন পর খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের নিয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনে নজরুল ইসলাম মঞ্জু কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়ে বলেন, ‘বিতর্কিত ও সুবিধাবাদী নেতৃত্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরোধী। যা খুলনার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শনে বিশ্বাসীরা প্রত্যাখ্যান করেছে। এই কমিটির প্রতি খুলনা বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীর কোনো সমর্থন নেই, আস্থা নেই ও বিশ্বাস নেই।’
নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, ২০১৮ সালে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ছিলেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। সে সময় তার কর্মকাণ্ড নিয়ে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি অংশ কেন্দ্রে অভিযোগ দিয়েছিলেন, তিনি জয়ের জন্য নির্বাচন করেননি। পরে এ নিয়ে তদন্ত করা হলে কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। সে থেকেই তার বিষয়ে অসন্তুষ্ট দলের হাইকমান্ড।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, খুলনা বিএনপির রাজনীতিতে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর ত্যাগ রয়েছে- যা দলের সবাই স্বীকার করেন। খুলনার কমিটি গঠনের আগে তা নিয়ে তাকে একাধিকবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার জন্য বলা হয়েছিল। তিনি বলেননি। কমিটি গঠনের পর তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে সংবাদ সম্মেলন করা ঠিক হয়নি। বিএনপি একটি বড় দল। ত্যাগীদের বাদ দেওয়া হলে তা মহাসচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে লিখিত জানালে সমাধান পেত। এ ঘটনায় তৃণমূলে বার্তা দেওয়া হয়েছে দলের শৃঙ্খলা নষ্ট করা হলে যেই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থায়ী কমিটির ওই সদস্য আরও জানান, জেলা কমিটির নেতৃত্ব স্থানীয় নেতাদের হাতেই দিতে চায় বিএনপি। সেক্ষেত্রে দুই পদে থাকা নেতারা শুধু কেন্দ্রের পদে থাকতে পারবেন। বেশ কয়েকটি জেলায় দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষ পদ আঁকড়ে থাকা নেতাদের এবার বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করা হচ্ছে। এটি করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ ওইসব জেলায় নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। তাই অনেক যাচাই-বাছাই করে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের নতুন কমিটিতে আনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কিছু ত্যাগী নেতা বাদ পড়তে পারেন। তাদের নামের তালিকা সংগ্রহ করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নতুন কমিটিতে তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।
বিএনপির একাধিক সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, সম্প্রতি ঘোষিত বরিশাল মহানগর কমিটি থেকে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারসহ তার অনুসারীদের বাদ দেওয়া হয়। সেখানে নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করেননি। একই অবস্থা রাজশাহী মহানগরেও। সেখানে নতুন কমিটি থেকে বাদ পড়েন প্রভাবশালী নেতা সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটিতে স্থান পাননি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সংসদ সদস্য হারুন অর রশিদের অনুসারীরা। এসব জেলায়ও একটি গ্রুপ নতুন কমিটির বিরুদ্ধে। কিন্তু কমিটিতে তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কেন্দ্রের আশ্বাস পেয়েছেন। সব জেলাকে ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে, কমিটি গঠনের পর কোনো আপত্তি বা দাবি থাকলে তা মহাসচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে জানাতে হবে। এ নিয়ে দলে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।