২০০৮ সালে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে একটি মামলা হয়। ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সময়ে অপরিশোধিত ভ্যাট, সুদ ও অর্থদণ্ড বাবদ ১৭ কোটি সাত লাখ টাকা দাবি করে মামলা করে এনবিআরের ভ্যাট-বিষয়ক বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। এক যুগ ধরে হাইকোর্ট বিভাগে মামলাটির একাধিক শুনানি হয়েছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। সবশেষে চলতি বছরের শুরুর দিকে গ্রামীণফোন মামলাটিকে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে এলটিইউ ভ্যাটের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) আওতায় নিয়ে আসে। আলোচনার মাধ্যমে এডিআরে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র দুই সপ্তাহে। এলটিইউর দাবি করা পুরো অর্থই পরিশোধ করেছে গ্রামীণফোন। কিন্তু তাতেও কোম্পানিটি খুশি। কারণ তারা মামলার খরচ ও ব্যবস্থাপনা থেকে রেহাই পেয়েছে।
একইভাবে গত অর্থবছরে দেশের সবচেয়ে বড় এই মোবাইল ফোন অপারেটর বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন তাদের সাতটি মামলা এডিআরে স্থানান্তরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করেছে। এসব মামলায় ৫১ কোটি ৬৪ লাখ টাকার রাজস্ব দাবি ছিল। এডিআরে গ্রামীণফোন ৫১ কোটি ১৪ লাখ টাকা পরিশোধের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করেছে। চলতি অর্থবছরেও বিভিন্ন আদালতে থাকা গ্রামীণফোনের আরও সাতটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে এভাবে। এসব মামলায় গ্রামীণফোনের কাছে দাবি ছিল ৪৯ কোটি সাত লাখ টাকা। এর মধ্যে ৫টিই এডিআরে কোনো রাজস্ব পরিশোধ ছাড়াই নিষ্পত্তি হয়েছে। একটি মামলায় ২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা দাবির বিপরীতে ৮ কোটি ৯ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। আরেকটি মামলায় কোনো অর্থ দাবি না থাকলেও এডিআরে আলোচনা শেষে ৩০ লাখ টাকা ভ্যাট দিতে হয়েছে। এ ছাড়া গ্রামীণফোনের বর্তমানে এডিআরে দুটি মামলা নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এই দুই মামলায় ৭৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা রাজস্ব জড়িত।
এলটিইউ ভ্যাটের অধীন অন্যান্য আরও কয়েকটি কোম্পানি তাদের মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলালিংক, বিএটি বাংলাদেশ, ইসলামী ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান তাদের ভ্যাটের মামলা আদালত থেকে এডিআরে এনে নিষ্পত্তি করছে। এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট নীতি) মো. মাসুদ সাদিক সমকালকে বলেন, বিভিন্ন মামলায় বছরের পর বছর ধরে অনেক রাজস্ব আটকে আছে। মামলা পরিচালনায় প্রচুর খরচ হয়। ব্যবস্থাপনার জটিলতাও রয়েছে। এ কারণে এনবিআর বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করছে। এটি আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম চর্চা। সম্প্রতি করদাতারাও আগের তুলনায় এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ভ্যাটের মামলায় বড় বড় কোম্পানি এডিআরে আসছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামীতে অন্য কোম্পানিগুলোও আসবে।
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কী: আদালতের নির্ধারিত প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে স্বল্পতম সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর বলে। এতে করদাতারা যেমন তাদের মামলার খরচ থেকে রেহাই পেয়ে থাকেন তেমনি সরকারও দ্রুত রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়। আপিল, ট্রাইব্যুনাল বা মহামান্য হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। এনবিআর মনোনীত একজন নিরপেক্ষ সহায়তাকারীর মধ্যস্থতায় করদাতা ও কর বিভাগের প্রতিনিধিদের মতৈক্যের ভিত্তিতে সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চুক্তি হয়। এ ক্ষেত্রে মামলাটি যে আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে বিচারাধীন রয়েছে, সেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এডিআর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হয়। মামলা নিষ্পত্তির জন্য করদাতাকে বিরোধীয় করের ৫ শতাংশ (সর্বনিম্ন দুই হাজার ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা) ফি দিতে হয়। এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি হতে সর্বোচ্চ সময় লাগে ৯০ দিন। এডিআরে মতৈক্য না হওয়ার ক্ষেত্রে করদাতা পুনরায় আদালতে ফিরে যেতে পারেন। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশের কর প্রশাসনে এ পদ্ধতি চালু হয়েছে।
এলটিইউ ভ্যাটের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আদালতে মামলা পরিচালনা করা বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের জন্যই কঠিন। এতে সময় ও অর্থ জড়িত। বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর মামলা থাকায় উচ্চ আদালত এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারেন না। এ কারণে কোম্পানিগুলো এডিআরে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। রাজস্ব বিভাগও চায় যে কোনো আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে।
মামলা নিষ্পত্তির পরিসংখ্যান: বাংলালিংক চলতি অর্থবছরে তাদের চারটি মামলা আদালত থেকে এডিআরে নিয়ে এসে নিষ্পত্তি করেছে। বিভিন্ন সময় বিধিবহির্ভূতভাবে ৪১ কোটি ৫৪ লাখ রেয়াত নেওয়া হয়েছে- এমন অভিযোগে এসব মামলা করা হয়। কিন্তু এডিআরের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলালিংক যে কর রেয়াত নিয়েছে, তা বিধিবহির্ভূত নয়। ফলে কোনো ধরনের রাজস্ব পরিশোধ ছাড়াই মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে।
এলটিইউ ভ্যাট সূত্রে জানা গেছে, বাংলালিংক তাদের আরও আটটি মামলা আদালত থেকে এলটিইউ ভ্যাটের এডিআরে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। একই সঙ্গে বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ তাদের একটি মামলা এডিআরে নিষ্পত্তি করেছে। মামলাটি ছিল ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কৃষকের সরবরাহ করা তামাকের ওপর উৎসে ভ্যাট আদায় নিয়ে। এতে ১৫৭ কোটি ২১ লাখ টাকার রাজস্ব দাবি ছিল। কোনো ধরনের রাজস্ব পরিশোধ ছাড়াই এডিআরে এ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড তাদের পাঁচটি মামলা আদালত থেকে এডিআরে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এলটিইউ ভ্যাটের এডিআরে অধিকাংশ মামলা সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে। মামলায় জড়িত অর্থ পরিশোধে কিস্তি সুবিধাও পাচ্ছে কোম্পানিগুলো।
বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (আয়কর) কমিশনার মো. ইকবাল হোসেন সমকালকে বলেন, করোনার সময় অনেক করদাতা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তাদের মামলা নিয়ে এসেছে এডিআরে। সম্প্রতি এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ হিসাবে সারাদেশে কাস্টমস, এক্সসাইজ, ভ্যাট, আয়কর ও বন্ড-সংক্রান্ত ৩২ হাজার ২৫৪টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় ৪৯ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা জড়িত। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তথ্য মতে, গত অক্টোবর শেষে কাস্টমস, এক্সসাইজ, ভ্যাট বিষয়ে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে পাঁচ হাজার ৫৪১টি মামলা অনিষ্পণ্ণ রয়েছে। আর ট্যাক্সেস আপিলাত ট্রাইব্যুনালে অক্টোবর শেষে অনিষ্পণ্ণ মামলার সংখ্যা এক হাজার ৮৮৫টি।
গ্রামীণফোনকে সম্মাননা: এডিআর ব্যবস্থায় আস্থা রেখে আদালত থেকে মামলা স্থানান্তর করা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে এলটিইউ ভ্যাটে সর্বোচ্চ সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করায় গত ১০ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে গ্রামীণফোনকে সম্মাননা জানিয়েছে এলটিইউ ভ্যাট। সম্প্রতি গ্রামীণফোন তাদের আয়কর-সংক্রান্ত বিচারাধীন মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য এনবিআরে যোগাযোগ করেছে।