ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের ২ হাজার ১৬৫ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। করোনার কারণে ঋণের ব্যবহার ব্যাহত হওয়া এবং সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে ঋণের অঙ্ক বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ না করায় সুদের অঙ্কও বাড়ছে। সব মিলিয়ে এসব ঋণের বিপরীতে বেশি সুদ ও ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ কারণেই ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে বৈদেশিক ঋণ ও বকেয়া এলসি দেনা পরিশোধ করায় রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। রিজার্ভ অক্টোবরে ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। করোনার কারণে ২০২০ সালে বৈদেশিক ঋণের ব্যবহার খুব কম হয়েছে। ২০২১ সালেও এ খাতে ব্যবহার ছিল কম। কিন্তু ঋণের বিপরীতে সুদ হিসাব কষা হয়েছে ঠিকই। এছাড়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করায় সুদ যোগ হয়ে ঋণের অঙ্ক বেড়েছে। স্থানীয় মুদ্রা আয়ের প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাজার থেকে ডলার কিনতে হবে। আগে প্রতি ডলার কেনা যেত ৮৫ থেকে ৮৬ টাকায়। এখন কিনতে হচ্ছে ৮৭ থেকে ৮৮ টাকায়। প্রতি ডলারে প্রায় ২ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। এতে টাকার অঙ্কে ঋণ বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ফলে ঋণ নিয়ে যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল, এখন এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে এর সঠিক ব্যবহার করতে পারলে ভালো। কিন্তু না পারলে পুরো অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করে। এদিক থেকে সতর্ক থাকতে হবে। বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকি থাকা দরকার। কেননা ঋণ পরিশোধের চাপটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরই আসবে। করোনার কারণে নীতিমালা অনেক শিথিল করা হয়েছে। যে কারণে এখন চাপ বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে এমন প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ নিলে ঝুঁকি কম। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয় না হলে ওইসব ঋণে ঝুঁকি বেশি। দেশে যেসব বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে তার খুব কম অংশ দিয়েই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, করোনার কারণে দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে। ২০২৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ছিল ১ হাজার ৬৯০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৬৫ কোটি ডলারে। এক বছরে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২৮ দশমিক ১১ শতাংশ। আগে এ ঋণ গড়ে ৮ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। করোনার সময়ে আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করার কারণে ঋণের অঙ্ক বেড়েছে।
ওই প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বৈদেশিক ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ। স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি বাড়লে ঝুঁকি থাকে। কেননা এগুলো দ্রুত পরিশোধ করতে হয়। এজন্য বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে গিয়ে চাপে পড়তে হয়। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে কম। দীঘমেয়াদি ঋণে ঝুঁকি কম থাকে। কেননা এগুলো পরিশোধে দীর্ঘ সময় পাওয়া যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বৈদেশিক ঋণে একসঙ্গে তিনটি ঝুঁকি এসেছে। এক. করোনার কারণে ঋণের ব্যবহার কমে যাওয়া, দুই. ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং তিন. করোনার কারণে হঠাৎ স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়ে যাওয়া। এগুলো মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। একটি পরিশোধ সূচি তৈরি করা হয়েছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত একটু চাপে থেকে এগুলো পরিশোধ করা হবে। রিজার্ভ বেশি থাকায় দুশ্চিন্তার কারণ কম। তবে রেমিট্যান্স কমে যাওয়াটা দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। রেমিট্যান্স বাড়ানো গেলে চাপ সহজে মোকাবিলা সম্ভব হবে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ৩০ জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ ১ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ১৮০ কোটি ডলার এবং দীর্ঘমেয়াদি ৬৮৯ কোটি ডলার। সরকারি খাতে মোট ঋণ ২৯৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৪৪ কোটি ডলার এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ২৫২ কোটি ডলার।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ ১ হাজার ৪০৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৮৭৩ কোটি ডলার এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৫৩৫ কোটি ডলার। সরকারি খাতে মোট ঋণ ছিল ২৮২ কোটি ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ২৫ কোটি ডলার এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ২৫৭ কোটি ডলার। এতে দেখা যায়, সরকারি খাতের চেয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে বেশি। স্বল্পমেয়াদি ঋণও বেসরকারি খাতে বেশি। যে কারণে এ খাতে ঝুঁকির মাত্রাও বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। সরকারি খাতে বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।