করোনার পর হুন্ডির বেড়াজালে আটকে পড়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। হুন্ডিবাজরা তৎপর হওয়ায় রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশই বৈধ পথে আসছে না। আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। যে কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এতে চাপ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায়। সূত্র জানায়, ছয় মাস ধরে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে রেমিট্যান্স কমার কারণ অনুসন্ধানে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাস এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কাজটি করা হয়। এতে দেখা যায়, হুন্ডিবাজরা সক্রিয় হওয়ায় ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স কমছে। এছাড়া আরও কয়েকটি কারণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আছে, করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশ্ব অর্থনীতি এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অনেক দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। করোনায় যেসব প্রবাসী চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই এখনো কাজে ফিরে যেতে পারেননি। এছাড়া যাদের বেতন কমেছিল, তারা আগের বেতনে যেতে পারেননি। নতুন করে কর্মী বিদেশে যাওয়ার সংখ্যাও কমে গেছে। এসব কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম। করোনার সময় রেমিট্যান্স বেড়েছিল, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে-প্রবাসীরা তাদের সঞ্চয় দেশে পাঠাচ্ছিলেন এবং হুন্ডি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার সময় রেমিট্যান্স কেন বাড়ল এবং এখন কেন কমছে, তা নিয়ে বিদেশে গিয়ে একটি গবেষণা হওয়া উচিত। এর প্রকৃত কারণ বের করে তার প্রতিকার দরকার। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্য রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে। রেমিট্যান্স কমলে অর্থনীতিও লন্ডভন্ড হয় পড়ে। এ বিষয়টি মনে রেখে রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়াটা জরুরি।
সূত্র জানায়, কয়েকটি দেশের দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, করোনা-পরবর্তী সময়ে প্রবসাসীদের ব্যাংকিং সুবিধা কমে গেছে। কেননা যাদের ব্যাংক হিসাব নেই, তারা অন্য কোনো প্রবাসীর ব্যাংক হিসাব থেকে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছিলেন। কিন্তু কোনো কারণে ওই প্রবাসী দেশে এসে আর যেতে পারছেন না। ফলে যাদের ব্যাংক হিসাব নেই, তারা এখন হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। প্রবাসীরা অনেক এলাকায় ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছেন না। ফলে তারা বাধ্য হয়ে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাংকিং সুবিধা বাড়াতে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় বাংলাদেশের এক্সচেঞ্জ হাউজ বা ব্যাংকের শাখা খোলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজ খোলা এবং ব্যাংকের শাখাগুলোর সেবার মান আরও বাড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রবাসীদের কাছে গিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করাসহ বহুমুখী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এজন্য বিদেশে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর উপশাখা খোলার অনুমোদনও দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, প্রবাসীরা ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রতি ডলারে ব্যাংক থেকে পাচ্ছেন ৮৪ থেকে ৮৫ টাকা। কোনো ক্ষেত্রে ৮৩ টাকাও পাচ্ছেন। এদিকে হুন্ডিতে পাঠালে ৮৮ থেকে ৯০ টাকা পাচ্ছেন। এখানে প্রতি ডলারে ৪ থেকে ৫ টাকা বেশি পাচ্ছেন। প্রণোদনা ২ শতাংশ দেওয়া হলেও হুন্ডিতে পাঠালেই তারা বেশি টাকা পাচ্ছেন। এছাড়া ব্যাংকে পাঠালে শতকরা ৪ থেকে ৬ শতাংশ খরচ হচ্ছে। হুন্ডিতে কোনো খরচ নেই। ব্যাংকে পাঠালে দ্রুত পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে নামের ভিন্নতায় রেমিট্যান্স পেতে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। হুন্ডি পাঠালে দ্রুত পেয়ে যাচ্ছেন। হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠালে কোনো জটিলতা নেই। কিন্তু ব্যাংকে পাঠালে নানা জটিলতা মোকাবিলা করতে হয়। নামের বানান ভুল বা ঠিকানা ভুল হলে রেমিট্যান্সের অর্থ তুলতে অনেক বেগ পেতে হয়। ব্যাংকে পাঠালে কোনো ঝুঁকি নেই। কিন্তু হুন্ডিতে বড় ধরনের ঝুঁকি আছে। এটি জেনেও প্রবাসীরা হুন্ডিতে পাঠাচ্ছেন। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে, এর ৪০ শতাংশই ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে। বাকি ৬০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ হুন্ডি এবং বাকি ৩০ শতাংশ আসে প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নগদ আকারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হুন্ডি বন্ধ হলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে। আপাতত হুন্ডি কমাতে বৈদেশিক মুদ্রার দরে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকের মধ্যে ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে পারলে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স কমবে। কেননা বর্তমানে হুন্ডিতে ডলারের বেশি দাম পাচ্ছে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম কমে গেলে হুন্ডি নিরুৎসাহিত হবে। এজন্য বাজারের নগদ ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হবে। বর্তমানে কার্বে প্রতি ডলার গড়ে ৯৩ থেকে ৯৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যাংকের বিক্রি হচ্ছে ৮৬ থেকে ৮৮ টাকা। সূত্র জানায়, বর্তমানে বিদেশে বাংলাদেশের ১ কোটির বেশি শ্রমিক কর্মরত। আগে প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ লাখ শ্রমিক বিদেশে গেছেন। করোনার কারণে ২০২০ সালে মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজার শ্রমিক বিদেশে যেতে পেরেছেন। চলতি বছরেও প্রবাসীদের নতুন কাজ নিয়ে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কম।
শ্রম অভিবাসন সংস্থার এক জরিপে বলা হয়েছে, গত বছর বিলম্বে বেতন পেয়েছেন এমন প্রবাসী ছিল ৪৭ শতাংশ। চাকরি চলে গেছে ২৬ শতাংশের। অস্থায়ী কাজ করতেন এমন প্রবাসী ছিল ২৭ শতাংশ। তাদের বেতনভাতা এখন স্বাভাবিক হয়নি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৩ লাখ ২৬ হাজার বিদেশ থেকে দেশে ফেরত এসেছেন। তারা সবাই এখনো যেতে পারেননি। এসব কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। প্রসঙ্গত, গত বছরের নভেম্বরে এসেছিল ২০৮ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। গত নভেম্বরে এসেছে ১৫৫ কোটি ডলার, যা গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ২৫ দশমিক ২৬ শতাংশ কম। এদিকে পরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোয় চিঠি দিয়ে হুন্ডিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রচলিত আইনে হুন্ডি নিষিদ্ধ। এ কারণে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে হুন্ডিবাজদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।