চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই সময়ে ৮৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বিপরীতে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৭৮ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে করদাতাদের জন্য সহজ পদ্ধতি প্রণয়নসহ ইলেকট্রনিক পেমেন্ট (ই-পেমেন্ট) ও ভ্যাট আদায়ে অটোমেটেড চালান (এ-চালান) দ্রুত চালু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নে সমন্বিতভাবে কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও মহানিয়ন্ত্রক কার্যালয়কে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং ক্যাশ অ্যান্ড ডেট ম্যানেজমেন্ট কমিটির (সিডিএমসি) পৃথক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায় কম, এটি আমাদের ঐতিহ্যে দাঁড়িয়েছে। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করতে হবে। এজন্য মনিটরিং জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে যতসংখ্যক টিআইএন-ধারী আছেন, রিটার্ন জমার সংখ্যা এর তুলনায় কম। কেন এটি হচ্ছে, সেখানে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এমন একটি নিয়ম করা হয়েছে-রিটার্ন জমা দিলে তাকে মিনিমাম কর দিতে হয়। এ ভয়ে অনেকে টিআইএন করলেও রিটার্ন জমা দিচ্ছেন না। অনেকে ভ্যাট নিচ্ছেন। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন মেশিন ব্যবহার করছেন না। এসব প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্বলতা দূর করতে হবে।
সূত্র জানায়, রাজস্ব পরিস্থিতি নিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে ওই বৈঠক হয়েছে। সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। বলা হয়, অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৮৮ দশমিক ৬২ শতাংশ (৭৮ হাজার ৭৯ কোটি টাকা) আদায় হয়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায় কম হলেও গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ের হার ছিল ৮৩ দশমিক ২১ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধি হয় ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
ওই বৈঠকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেষ্ট থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া রাজস্ব খাতের সংশ্লিষ্ট দপ্তরপ্রধানদের যথাযথভাবে মনিটরিং করে প্রতিমাসে গবেষণা ও পরিসংখ্যান বিভাগের মহাপরিচালকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সমন্বয় সভায় উপস্থাপনেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, বৈঠকে ভ্যাট আদায় বাড়ানোর জন্য ইএফডি (ইলেকট্রনকি ফিসক্যাল ডিভাইস) মেশিন স্থাপন, অনলাইনে ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন, সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা, ই-পেমেন্টে আয়কর আহরণ, অন্যান্য কর বিক্রয় ও করদাতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়।
রাজস্ব পরিস্থিতি নিয়ে একধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে সরকার। কারণ, বর্তমান চিকিৎসা খাতে ব্যয় বেড়েছে। এটি সামাল দিতে গিয়ে সরকারকে বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছে রাজস্ব খাতে। অপরদিকে সেভাবে রাজস্ব আদায়ের হারও বাড়ছে না। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ে ‘ক্যাশ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (সিডিএমসি) কমিটির বৈঠকে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সিনিয়র অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার। বৈঠকের একটি সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়ের আওতা বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা অব্যাহত রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ সচিব। সেখানে বলা হয়, রাজস্ব আদায় কার্যক্রম পুরোপুরি ‘এ-চালান’-এর আওতায় আনতে হবে। তবে সেটি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত করদাতাদের রাজস্ব প্রদান আরও সহজ করতে ই-পেমেন্ট পদ্ধতি ও ভ্যাট আদায়ে এ চালানব্যবস্থা দ্রুত চালুর ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে যে রাজস্ব আদায় হবে, সেটি সরাসরি সরকারের ট্রেজারিতে জমা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
জানা যায়, করোনাকালীন চলতি অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এরই মধ্যে অনেকটাই গতি ফিরেছে অর্থনীতির। চাঙা হয়ে উঠছে ব্যবসা-বাণিজ্য। পরিস্থিতি আগের তুলনায় স্বাভাবিক হলেও গেল চার মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে চলে আসছে করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’। এই ভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক বাড়ছে।
‘ওমিক্রন’ শনাক্ত হওয়া দেশগুলো থেকে আসা-যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা ও সভা-সমাবেশ সীমিত করাসহ চার সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় কিছু সফর বাতিল করা হয়েছে। জেনেভায় বাণিজ্য সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বৈঠক ডব্লিউটিও মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্স বাতিল করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আগামী তিন ডিসেম্বর থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। এছাড়া ইউরোপের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার আবার সংকটের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি আরেক দফা সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত আছে। অর্থনীতিতে কোনো ধরনের প্রতিঘাত যেন না আসে, সেজন্য রাজস্ব খাতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।