করোনার সময়ে ছাঁটাই বা পদত্যাগে বাধ্য করা ব্যাংকারদের পুনর্বহালে নির্দেশ দিলেও তা এখনো কার্যকর করা হয়নি। এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে মানছে না বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ফলে হতাশ হয়ে যাচ্ছেন ভুক্তভোগী ব্যাংকাররা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালন করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে আবারও পরিদর্শন করব। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি চাকরি ফেরত না পেলে প্রথমে কৈফিয়ত তলব করব, জবাব সন্তোষজনক না হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী চাকরি হারানো ব্যাংক কর্মকর্তাদের দ্রুত পুনর্বহাল করা উচিত। তা না হলে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেউ দণ্ডনীয় অপরাধ করলে সেটা ভিন্ন। কিন্তু করোনার মধ্যে যৌক্তিক কারণ ছাড়া যাদের ছাঁটাই বা পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা উচিত। খরচ কমানোর আরও অনেক খাত আছে। চাকরিচ্যুতি খরচ কমানোর কোনো খাত হতে পারে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৬ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করে, প্রমাণিত কোনো অভিযোগ ছাড়া এখন থেকে ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। করোনা ভাইরাসের এ সময়ে শুধু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ বা অদক্ষতার কারণ দেখিয়েও কাউকে ছাঁটাই করা যাবে না। আর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও করোনার এই সময়ে যাদের চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে আবেদন সাপেক্ষে তাদের পুনর্বহাল করতে হবে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, করোনার এ সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা হলে কর্মীদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে মনোবল ও কর্মস্পৃহা কমবে। ভবিষ্যতে মেধাবী ও অভিজ্ঞরা ব্যাংকে যোগদানে অনীহা দেখাবে। দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং খাতের জন্য যা ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ রকম প্রেক্ষাপটে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং কর্মস্পৃহা অটুট রাখার স্বার্থে এসব নির্দেশনা দেওয়া হলো। এরপর ভুক্তভোগীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংক এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
এই মুহূর্তে চাকরি পুনর্বহালের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ছাঁটাইয়ের শিকার ব্যাংকাররা। একবার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, একবার চেয়ারম্যান আবার গভর্নরের দপ্তরে চিঠি দিয়েও কোনো সুফল পাননি হাজারও ভুক্তভোগী। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে হতাশাগ্রস্ত এসব ব্যাংকার উল্লেখ করেন, দীর্ঘদিন যাবত সুখে-দুঃখে ব্যাংকের সঙ্গে ছিলাম।
অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বিভাগীয় প্রধান, শাখা ব্যবস্থাপক, জোনাল হেডসহ বিভিন্ন উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করে এসেছি। বর্তমানে প্রায় সবাই চাকরি জীবনের মাঝামাঝি কিংবা শেষ প্রান্তে। প্রত্যেকের সন্তানেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছে। অনেকের গৃহনির্মাণসহ অন্যান্য ঋণের কিস্তি চলমান রয়েছে, যা বেতন-ভাতা থেকে নির্বাহ করি।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, করোনার এই সময়ে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অন্যায় ও অমানবিকভাবে ব্যাংকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ এবং শাখা প্রধানসহ মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকে টার্মিনেট করা, সার্ভিস বেনিফিটসহ আর্থিক সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত করাসহ নানাবিধ হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
করোনার এই সময়ে যখন অন্যত্র চাকরি হওয়ার/পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন কেউ-ই যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিনি বা পদত্যাগের নোটিশ প্রদান করিনি তা সহজেই বোধগম্য/অনুমেয়। ইতোমধ্যে প্রত্যেক ভুক্তভোগী চাকরি পুনর্বহালে পৃথক আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছি না। এ অবস্থায় আমাদের আবেদন, সবাইকে সসম্মানে পুনর্বহাল করা হোক। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের একাধিক ভুক্তভোগী ব্যাংকার বলেন, চাকরি ফেরত পেতে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আবেদন করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পায়নি।
যমুনা ব্যাংকের কয়েকজন ভুক্তভোগী ব্যাংকার জানান, করোনার এই সময়ে প্রায় ২০০ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই এবং বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে যমুনা ব্যাংক। গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে চাকরি ফেরতে আবেদন করেছি। এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককেও জানিয়েছি। একইভাবে ওয়ান ব্যাংকের দুইজন ভুক্তভোগী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চাকরি ফেরতে আবেদন করেছেন, কিন্তু এখনো কোনো সাড়া মেলেনি।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকারদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেসরকারি খাতের ৬টি ব্যাংকে কর্মী ছাঁটাই বিষয়ে বিশেষ পরিদর্শন করে। এতে উঠে আসে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলোর মোট ৩ হাজার ৩১৩ জন কর্মকর্তা চাকরি ছেড়েছেন। এর মধ্যে বয়স থাকার পরও ‘স্বেচ্ছায় পদত্যাগ’ দেখানো হয়েছে ৩ হাজার ৭০ জনকে। এছাড়া ২০১ জনকে অপসারণ, ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখানো বেশিরভাগই জানিয়েছেন, স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য মৌখিকভাবে তাদের একটি সময় দেওয়া হয়েছিল। ওই তারিখের মধ্যে পদত্যাগ না করলে কোনো সুবিধা দেওয়া হবে না এমন ভয় দেখানো হয়। এমন প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন।