বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় দেশেও দাম বাড়ানোর চাপ বাড়ছে। এই মুহূর্তে দাম বাড়ানো হলে প্রায় সব খাতেই এর প্রভাব পড়বে। ফলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত হবে। শনিবার বিকালে জ্বালানির দাম বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. জাহিদ বলেন, পেট্রোল, ডিজেল ও অকটেনের দাম বাড়বে। পাশাপাশি সার ও কয়লার দাম বাড়বে। এগুলোর সঙ্গে বলতে গেলে সবকিছুরই সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে সার বাংলাদেশে অনেকটা উৎপাদন হলেও অন্যগুলো সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। এগুলোর দাম আবার সরকার নির্ধারিত। শোনা যাচ্ছে, সরকার এগুলোর দামের সমন্বয় করবে। ইতোমধ্যে অনেক পক্ষ থেকে দাম বাড়ানোর প্রস্তাবও করা হয়েছে। যদি দাম বাড়ানো হয় তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম বাড়ায় বৈদেশিক বাণিজ্য ভারসাম্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমদানি খরচ বড়ে যাবে। এরই মধ্যে জুলাই-আগস্ট দুই মাসে ১ হাজার কোটি ডলারের মতো আমদানি ব্যয় হয়েছে। শুধু দাম বৃদ্ধির কারণে এমনটি হয়েছে। এদিকে ডলারের দাম বেড়েছে জোগানের তুলনায় চাহিদা বৃদ্ধির কারণে। ফলে মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। এসব কারণে সব পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার যদি ডিজেল, এলএনজি ও কয়লার দাম বাড়ায়, তাহলে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে। ফলে ডিজেলনির্ভর বোরো আবাদে খরচ বাড়বে। বিদ্যুতের দাম বাড়ার সঙ্গে সারের দামও বাড়বে। সার্বিকভাবে সব ধরনের শস্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে গম ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি ঝুঁকিতে রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে। সবকিছু মিলে বলা যায়, মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে।
জ্বালানি তেলের দাম না বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রশ্নটা হচ্ছে-আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে দেশে পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থের দাম বাড়ানো উচিত কি না? সাধারণভাবে মনে হবে হ্যাঁ, বাড়ানো দরকার। সেটি না হলে যারা বা সরকারি যেসব সংস্থা আমদানি করে, তারা লোকসান করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ৭-৮ বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল। অর্থাৎ ৪০-৪৫ ডলারের আশাপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। তখন তো দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করে কমানো হয়নি। তখন অবশ্য বলা হয়েছিল, কোম্পানিগুলোর আগের যে লোকসান দিয়েছিল এখন সেটি পুষিয়ে নিচ্ছে। তাহলে আগের বছরগুলোয় যে মোটা অঙ্কের লাভ হলো, সেগুলো কোথায় গেল? এখন আবার দাম বাড়াতে হবে কেন?
এখানে আরও একটি কথা বলে রাখা দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে যে কোনো সময় আবার দাম কমে যেতে পারে। এখন বিশ্বব্যাপী চলাচল বেড়ে গেছে। গত বছর করোনার কারণে মানুষের চাহিদা থাকার পরও সেটি পূরণ করা যায়নি। কিন্তু এখন সেই চাহিদা পূরণ করতেই মানুষ এদিক-সেদিক ছুটছে। এটা সাময়িক। কেননা এই চাহিদা অস্বাভাবিক হচ্ছে আগের চাহিদাসহ এখনকারগুলো পূরণ করা হচ্ছে বলেই। বছরখানেক পরই আবার সবকিছুই স্বাভাবিক হতে পারে। তখন জ্বালানি তেলের দামও কমে আসতে পারে। এছাড়া করোনা মহামারির কারণে এখনো অনেক বন্দর পুরোপুরি কার্যক্রম করতে পারছে না। বন্দরগুলোয় কনটেইনার জট লেগেই আছে। ফলে সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই অবস্থা যখন স্বাভাবিক হবে, তখন জ্বালানি তেলের দামও কমতে পারে। তখন কি সরকার আবার দাম কমাবে? সেটি তো অতীতে কখনো দেখা যায়নি। তাহলে এখন বাড়ানোর তোড়জোড় কেন?
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডিজেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব আছে। এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতি যেখানে পুনরুদ্ধারের পথে, সেখানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো যৌক্তিক হবে না। এতে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। কেননা যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ছিলেন, করোনার কারণে কাজ হারিয়েছিলেন। তারা কেবল তাদের কাজ ফিরে পেতে শুরু করেছেন। তবে মজুরি করোনার আগের পর্যায়ে এখনো যায়নি। এই মুহূর্তে সেসব মানুষের জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্রে খারাপ প্রভাব পড়বে। নিম্ন আয়ের মানুষের মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামাল দেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, সাময়িকভাবে হলেও সরকারের উচিত ভর্তুকি দিয়ে চালানো। জটিলতা এড়াতে মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া সংস্কার জরুরি। যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়লে দেশেও বাড়ানো যায়, আবার কমলে দেশেও কমানো যায়। তাহলে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। এছাড়া একটু দেখাও দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতেও পারে। অন্তত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখে তারপরই দাম সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।