বিচারক ও আইনজীবীদের মতবিরোধের জের ধরে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাগেরহাটে দু’টি আদালত বন্ধ রয়েছে। ফলে দিনের পর দিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিচার প্রার্থীরা। একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হলেও সুরাহা হয়নি। বিরোধ মিটিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে পুনরায় আদালত চালু হবে বলে আশা করছেন বাগেরহাট জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী।
আইনজীবী ও আদালত সূত্রে জানা যায়, বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-১ এবং সিনিয়র সহকারী জজ (সদর) আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে অশোভন আচরণ ও অনিয়মের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় আইনজীবী সমিতি। এরপর থেকেই এ দু’টি আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। যার ফলে দুই আদালতের পাঁচ সহস্রাধিক মামলার বিচারকাজও আটকে গেছে। দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হয়েছে বিচারে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাদী, বিবাদী, বিচারপ্রার্থী ও আসামিরা। এ অবস্থায় দ্রুত আদালত চালুর দাবি জানিয়েছেন বিচারপ্রার্থীরা।
বাগেরহাট সিনিয়র সহকারী জজ (সদর) আদালতে জমিজমা সংক্রান্ত মামলা করেছেন শেখ মোফাজ্জেল নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, বছর তিনেক আগে জমিজমা সংক্রান্ত মামলা করেছিলাম। কিন্তু এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। তার মধ্যে প্রায় দেড় বছর ধরে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ। আর কতদিন ঘুরব আমরা? বিচারক ও আইনজীবীদের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি নিরসনের দাবি জানাচ্ছি।
বিচারপ্রার্থী বাগেরহাট সদর উপজেলার চাপাতলা গ্রামের দেলোয়ার হোসেন বলেন, ২০১৯ সালে জমি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সিনিয়র সহকারী জজ (সদর) আদালতে একটি মামলা করেছিলাম। ধার্য তারিখে আদালতে হাজির হওয়ার পর দেখি আইনজীবীরা আদালত বর্জন করছেন। দুই থেকে তিন বার একই ঘটনা ঘটেছে। ধার্য তারিখে আসি, আর ফিরে যাই। কিন্তু বিচার কাজের কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। প্রতি তারিখেই আসি, আর ফিরে যাই। এভাবে আর কতদিন কোর্টের বারান্দায় ঘুরব, কবে চালু হবে এ আদালত, তাও তো জানায় না কেউ।
তিনি আরো বলেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই তো মানুষ আদালতে আসে। সেখানে যদি এ ধরনের অবস্থা থাকে, তাহলে আমরা কই যাব? আইনজীবী এবং বিচারকদের বিরোধে আমরা কেন ভোগান্তিতে পড়ব? আমরা চাই, দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয় করে আবার আদালত চালু হোক। শুধু দেলোয়ার আর মোফাজ্জেল নন, এ অচলাবস্থায় অনেক বিচারপ্রার্থী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এছাড়া অনেক আসামি বিনা বিচারে কারাভোগও করছেন।
বাগেরহাট জেলা জজ আদালতের আইনজীবী শিকদার ইমরান বলেন, আদালত বর্জন করায় বিচারপ্রার্থীরা যেমন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তেমনি আমরাও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছি। মক্কেলরা বার বার ফোন করে জানতে চান যে কখন আদালত চালু হবে। আপনারা না গেলে বিচারক কি রায় দিয়ে দেবে- এমন নানা প্রশ্ন শুনতে হয় আমাদের। তিনি আরও বলেন, এক মক্কেলের হত্যা মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল ছয় মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার। যদি নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হয়, তাহলে তাকে উপযুক্ত আদেশ দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু বছরকে বছর পার হলেও কোনো যুক্তিতর্ক না হওয়ায় বিনা বিচারে অভিযুক্ত এখনো জেলে রয়েছেন।
বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ড. একে আজাদ ফিরোজ টিপু বলেন, আদালত চলাকালে দু’জন বিচারক আইনজীবীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। পরে আমরা বিষয়টি সমাধানের জন্য আদালত কর্তৃপক্ষকে ১৫ দিনের সময় দিয়েছিলাম। কোনো সমাধান না হওয়ায় আইনজীবী সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা আদালত বর্জন করেছি।
তিনি আরও বলেন, অবিচারক সুলভ আচরণ ও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে আদালত বর্জন রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দু’টি আদালত এক বছর ধরে বন্ধ থাকায় বিচারপ্রার্থীদের অবর্ণনীয় ক্ষতি হচ্ছে। দ্রুত দুই বিচারককে প্রত্যাহার করে সৎ ও নিষ্ঠাবান বিচারকদের পদায়নের দাবি জানাই। বাগেরহাট জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী জানান, আইনজীবী ও বিচারকদের মধ্যে দ্বন্দ্বে বিচারপ্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। বার এবং বেঞ্চে আলাপ হয়েছে। আশা করি, দ্রুতই এর সমাধান হয়ে যাবে।
বাগেরহাট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেন, পুরাতন আদালত ভবনের জমি নিয়ে বাগেরহাট আইনজীবী সমিতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। সেই থেকে আদালত বর্জন রয়েছে। এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি তদন্ত কমিটির প্রতিনিধি দল এসেছিল। ত্রিপক্ষীয় সমন্বয়ে একটি বৈঠক হয়েছিল। পরে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা এখনো জানা যায়নি।