উপমা কবিরের গল্পটা একটু ভিন্ন। ১৯৯২ সালে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল। উপমা বলেন, ‘আব্বাদের সময়ে কারিগরি শিক্ষা তেমন মূল্যবান ছিল না। ভালো সাবজেক্ট বলতে তখন সবাই বুঝত অর্থনীতি, সাহিত্য, গণিত। তবে আমার মামা ছিলেন ফিজিকসের প্রফেসর এবং একজন কালি নারায়ণ স্কলার। তাই মা ভাবত, ভালো ছাত্র মানেই বিজ্ঞানের ছাত্র।’ শৈলী কবির যোগ করলেন, ‘আম্মা বলতেন, আধুনিক যুগের মানুষ, আধুনিক বিষয়ে পড়বে। তাঁর চিন্তাভাবনা অনেক সুদূরপ্রসারী ছিল।’
প্রকৌশলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখনো দেশে নারীরা সংখ্যায় কম। সেখানে তিন বোনই প্রকৌশলে আগ্রহী হতে গিয়ে কখনো কি কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন? তিনজন একসঙ্গে উত্তর দিলেন—না। প্রকৌশলে কেন পড়বে—এই প্রশ্ন তাদের ঘরের দরজা দিয়ে ঢোকেনি কখনো। উপমা বলেন, ‘আমার বাবা ভীষণ উদার একজন মানুষ। তিনি মনে করতেন, একজন মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্য দিয়েই বিকশিত হয়। রাত ১২টায় রিকশায় করে ঘোরা, পূজামণ্ডপ দেখা, লোডশেডিংয়ের সময় গলা খুলে গান গাওয়া, বাড়িতে বন্ধুবান্ধবের আসা–যাওয়া—এগুলো আমাদের জন্য খুব স্বাভাবিক ছিল।’
গল্পে গল্পে জানা হলো, তিন বোনই মেডিকেল বা বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগ ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। উপমা কবির বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টা অনেক বড়, এখানে মনটাও বড় হয়ে যায়। আমার কাছে মনে হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আরও ঔদার্যভরা একটা দৃষ্টিভঙ্গি পাব।’ সঙ্গে শৈলী কবির যোগ করলেন, ‘মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট পাই। কম্পিউটার সায়েন্সে চান্স পেয়েছি দেখে ঢাবিতে চলে আসি; কারণ, মনে হয়েছে এটাই আমার আপন জায়গা।’
একই বিভাগে পড়ালেও অবশ্য তাঁরা একসঙ্গে কাজ করতে পেরেছেন খুবই কম। উচ্চতর শিক্ষার জন্য কেউ না কেউ দেশের বাইরে ছিলেন। তবে মিত্রা কবির বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের দিনের এক বিরল ঘটনার কথা। বাবা, তিন বোন এবং দুজনের স্বামী—একসঙ্গে ৬ জন শিক্ষক হিসেবে ভোট দিতে গিয়েছিলেন। দিনটি তাঁদের জন্য সত্যিই অন্য রকম গর্বের ছিল।
শিক্ষক পরিবারের পরের প্রজন্মও কি একই পথে হাঁটার স্বপ্ন দেখছে? শৈলী কবির বলেন, ‘শিক্ষক হওয়া সহজ নয়। একটা জাতিকে গড়ে তোলার দায়িত্ব থাকে শিক্ষকতায়। আমি অবশ্যই চাই এমন সম্মানের একটা জায়গা তাঁরা নিজেদের জন্য গড়ে তুলুক, নিজ নিজ যোগ্যতায়।’তিন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপে বারবার ঘুরেফিরে আসছিল মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের বেড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল—নিজের মতো করে মানুষ হওয়ার স্বাধীনতা। উপমা কবির বলেন, ‘সব মা–বাবাই সন্তানকে ভালোবাসেন, কিন্তু খুব কম মা-বাবাই সন্তানের বন্ধু হতে পারেন। আমাদের মা-বাবা সেটা পেরেছিলেন।’ মিত্রা কবির যোগ করলেন, ‘এটা তুমি বলতে পারবে না, ওটা তুমি করতে পারবে না—এ রকম কিছু কখনো শুনতে হয়নি। তাই আত্মবিশ্বাস সব সময় ছিল।’