আগামী ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দল মনোনীত চূড়ান্ত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। গত তিন দিনে তৃণমূল নেতারা এসব অভিযোগ আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন।
লিখিত এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে—অর্থের বিনিময়ে বিএনপির নেতা, রাজাকারের সন্তান-নাতি, ইয়াবা ব্যবসায়ী, হত্যা মামলার আসামিসহ বিতর্কিত বিত্তশালীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এতে বঞ্চিত হয়েছেন সত্, নিবেদিত ও ত্যাগী নেতারা। কেন্দ্রে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার না পাওয়ায় গতকাল রবিবার সকালে ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে পটুয়াখালী জেলার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের একটি গ্রুপ বিক্ষোভ মিছিল করে। এ সময় তারা প্রতিবাদের অংশ হিসেবে ‘বিএনপির হাতে নৌকা কেন’ স্লোগান দিতে থাকে।
রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের পাঁচটি (ঢাকা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ) জেলার দ্বিতীয় ধাপের আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দল মনোনীত একক চেয়ারম্যান প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের নামও ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি প্রার্থী চূড়ান্ত করতে মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু, অনেক জায়গায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদককে মনোনয়ন না দিয়ে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত বিত্তশালীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য জানান, প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে তৃণমূলের নেতারা যে প্রস্তাব কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন, সেখানে বিতর্কিতদের নাম রয়েছে। এক্ষেত্রে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। তথ্য গোপনও করা হয়েছে। এ কারণে কিছু জায়গায় বিরোধী মতাদর্শীরা মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে তৃণমূল থেকে অভিযোগ আসছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দল মনোনীত প্রার্থী পরিবর্তন করা হবে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নৌকা প্রতীক পাওয়া কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেলে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করবে আওয়ামী লীগ। অর্থাত্, প্রার্থী বদল করা হবে। এজন্য ধানমন্ডির কার্যালয়ে অভিযোগ জমা দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। মনোনয়ন বোর্ডের সভার মেয়াদ শনিবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তৃণমূল পর্যায় থেকে আসা নানা আপত্তির কারণে আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত বৈঠকের সময় বাড়ানো হয়েছে।
মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য জানান, চাল-গম চুরি ও অনিয়মে জড়িত ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান কোনো চেয়ারম্যানকেই মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভুল ও তথ্য গোপনের কারণে বিতর্কিত কারো মনোনয়ন পাওয়ার অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে কেন্দ্রে অভিযোগ দেওয়ার পাশাপাশি তৃণমূলেও বিক্ষোভ করছেন অনেক নেতাকর্মী। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার ৭ নম্বর কাজীরবেড় ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী একজন চিহ্নিত রাজাকারের সন্তান বলে তৃণমূল নেতারা অভিযোগ করেছেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের করা রাজাকারের তালিকায় তার বাবার নাম ১০১ নম্বরে। তিনি ইউনিয়ন বিএনপির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনও করেছেন।
পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. কাজী আলমগীর ও সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ভিপি আব্দুল মান্নান যৌথ স্বাক্ষরে শনিবার ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে একটি চিঠি জমা দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মো. আসাদুল ইসলাম আসাদ পটুয়াখালী সদর উপজেলাধীন মরিচবুনিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তার আপন বড় ভাই মো. রফিকুল ইসলাম মুন্সি মরিচবুনিয়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক। এছাড়া আসাদের আপন মামাশ্বশুর মরিচবুনিয়া ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক। আসাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন সবাই বিএনপি মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিলে নৌকার বিজয় অনিশ্চিত।
কিন্তু শনিবার রাতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ঘোষিত দল মনোনীত একক প্রার্থীর তালিকায় ছিল মো. আসাদুল ইসলাম আসাদের নাম। এতে জেলা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা হতাশ। বরিশাল জেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগ এবার এমন একজনকে মনোনয়ন দিয়েছে, যিনি অতীতে উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি, ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক এবং সাবেক সহসভাপতি ছিলেন।
বগুড়ায় ২০ ইউপি নির্বাচনে নৌকার মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে কেউ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত, কারো বিরুদ্ধে হত্যা মামলা, কেউ মানবিক সহায়তার অর্থ আত্মসাত্কারী। আবার কারো বিরুদ্ধে সরকারি গাছ কাটা, মাদক ব্যবসা, বিরোধী দলের সঙ্গে ব্যবসা করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এতে তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। নাটোরের বড়াইগ্রামে একটি ইউপিতে জামায়াত নেতার মেয়েকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ডুমুরিয়া উপজেলার ৬ নম্বর মাগুরা-ঘোণা ইউনিয়নে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র সহসভাপতি মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু তাদের মনোনয়ন না দিয়ে সাবেক যুবলীগ নেতা ও স্থানীয় ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
এদিকে দুটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থিতা পরিবর্তন করেছে আওয়ামী লীগ। গত রাতে আওয়ামী লীগের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শুক্রবার বিকেলে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মনোনীত প্রার্থীদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত তালিকায় অসাবধানতাবশত নিম্নোক্ত দুটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত প্রার্থীর পরিবর্তে ভুল নাম লিপিবদ্ধ হয়। প্রকৃতপক্ষে এ দুটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা হলেন মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুরে মো. রেজাউর রহমান এবং খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়ায় প্রতাপ কুমার রায়।