পুলিশি নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদের স্ত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন মামলার প্রধান আসামি পুলিশের বহিষ্কৃত উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূইয়া। একই সঙ্গে মামলায় আপসের শর্তে রায়হানের মা ও সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেওয়ারও প্রস্তাব দেন তিনি।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক আওলাদ হোসেনের দেওয়া অভিযোগপত্রেও আকবরকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। আর সিলেট মহানগর পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে রায়হানকে নির্যাতনের সত্যতা মেলায় বহিষ্কার করা হয় তাকে।
এসআই আকবর রায়হানের মৃত্যুর পরই পালিয়ে যান । গত বছরের ৯ নভেম্বর দুপুরে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে আকবরসহ অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্য কারাগারে থাকলেও নোমান পলাতক। জেল থেকে তিনি এক পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে এমন প্রস্তাব দেন।
দেশে-বিদেশে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় মামলায় সাক্ষ্য দিতে গত মাসে রায়হানের মা সালমা বেগম, স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী ও সৎবাবা হাবিবুল্লাহকে পুলিশ সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার ফটকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় আকবরসহ অন্য আসামিদেরও তাদের সামনে হাজির করা হয়। তখন আকবর তাদের কাছে ক্ষমা চান।
রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, ওইদিন আকবর আমার ও আমার স্বামীর পা ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেন। তিনি ক্ষমা চেয়ে আমাদেরকে তার প্রাণভিক্ষা দেওয়ার জন্য বলেন। আমাদের যাবতীয় দায়িত্ব নেবেন বলেও জানান আকবর। সেদিন আকবর আমাকে বলেছিল, আমরা ভুল তথ্য পেয়ে রায়হানের মতো ভালো একটি ছেলেকে নির্যাতন করেছি। আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা বুঝতে পারিনি। আমাদের ক্ষমা করে দিন।
সালমা বেগম বলেন, আকবরকে কখনও ক্ষমা করবেন না। ও আমার নিরপরাধ ছেলেকে খুন করেছেন। তাকে আমি কখনোই ক্ষমা করব না। আমাদের ভরণ-পোষণের চিন্তা করতে হবে না। পারলে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন। রায়হান যখন মারা যান তখন তার মেয়ে আলফার বয়স ছিল দুই মাস। সেই মেয়ে এখন ১৪ মাস বয়স। হাঁটা শিখছে। ধীরে ধীরে কথাও ফুটছে তার মুখে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর মামলার কাজে আদালতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি নাতনিটা কেবল বাবা বাবা করছে। সব সময়ই সে বাবাকে খোঁজে। কিন্তু পায় না। তার জন্য বুক ফেটে যায়। এই শিশুকে যে এতিম করেছে তাকে কী করে ক্ষমা করব? তিনি বলেন, তাদের এই ক্ষমা প্রার্থনা আর বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাবই প্রমাণ করে তারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। গত বছরের ১১ অক্টোবর ভোরে সিলেট নগরের আখালিয়ার এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে (৩৩) কাষ্টঘর এলাকা থেকে ধরে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করেন ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়াসহ পুলিশ সদস্যরা। পরে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
পুলিশের হেফাজতে নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। রায়হান হত্যার পরদিন ১২ অক্টোবর তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও ১৩ অক্টোবর মামলাটি স্থানান্তর করা হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে। হত্যাকাণ্ডের ৭ মাসের মাথায় গত ৫ মে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন বরখাস্ত হওয়া এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর ইন্সপেক্টর আওলাদ হোসেন।
পুলিশ হেফাজতে রায়হানরে মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত রিপোর্টে রায়হানের শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযুক্তরা হলেন- প্রধান অভিযুক্ত বন্দরবাজার ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভুঁইয়া, ফাঁড়ির টু-আইসি উপ-পরিদর্শক (এসআই) হাসান উদ্দিন, এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস, হারুনুর রশিদ ও ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ গায়েবকারী কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। আসামিদের মধ্যে পাঁচ পুলিশ সদস্য কারাগারে থাকলেও নোমান এখনও পলাতক রয়েছেন।