পৌরসভা আইনে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। প্রস্তাবিত আইনের সংশোধনে প্রশাসক নিয়োগ সুযোগ রাখা হচ্ছে। পরিবর্তন আনা হচ্ছে সচিব পদের নামে। সেইসঙ্গে যেসব পৌরসভা ঠিকমতো বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারবে না সেগুলোর পরিষদ বাতিলের বিষয়েও প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী মেয়রদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সেখানে প্রশাসক নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই।
আজ মন্ত্রিসভা বৈঠকে পৌরসভা আইনের সংশোধন প্রস্তাব উঠতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আরও জানা গেছে, বিদ্যমান ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন-২০০৯’ এ পৌরসভা গঠন হওয়ার পর নির্বাচনের আগ পর্যন্ত প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ আছে। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নির্বাচন না হলে আগের মেয়র ও কাউন্সিলররা দায়িত্বে থাকেন।
আইন সংশোধনে মন্ত্রিসভার সায় পাওয়া গেলে নতুন বা পুরনো যে কোনো পৌরসভায় নির্বাচনসংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হলে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে। তবে মন্ত্রিসভা বৈঠকে যদি এ বিষয়ে ভিন্ন কোনো পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় তাহলে এ প্রস্তাবের ব্যতিক্রমও হতে পারে। বিদ্যমান আইনের সুযোগ নিয়ে অনেক এলাকার পৌর মেয়ররা নির্বাচিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নিজেদের লোকজন দিয়ে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে আদালতে মামলা ঠুকে দেন। এতে মামলা নিষ্পত্তির আগে পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ থাকে না।
আর মামলা বছরের পর বছর চলার সুযোগে আগের মেয়রই দায়িত্ব পালন করেন। এমন সমস্যা থেকে উত্তরণে পৌরসভায় প্রশাসক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আইনটি পাশ হলে পৌরসভায় প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে। উল্লিখিত জটিলতার কারণে হবিগঞ্জের আজমেরীগঞ্জ পৌরসভায় প্রায় দেড়যুগ নির্বাচন হচ্ছে না। ২০০৪ সালের ২১ জানুয়ারি আজমেরীগঞ্জকে পৌরসভা ঘোষণা করে সরকার।
এর পরপরই প্রাথমিকভাবে প্রশাসকের দায়িত্ব পান স্থানীয় বিএনপি নেতা গোলাম ফারুক। তার নেতৃত্বে পৌরসভার সীমানা নির্ধারণ সম্পর্কিত ঘটনায় আদালতে মামলা হলে সীমানা নির্ধারণে স্থগিতাদেশ দেন আদালত। এরপর টানা ১৪ বছরের বেশি প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন গোলাম ফারুক। বছর দেড়েক আগে আদালতের অপর এক আদেশের প্রেক্ষিতে গোলাম ফারুককে ওই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এখন অভিভাবকহীন এ পৌরসভায় দেখভালের দায়িত্বে আছেন স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। নীলফামারীর পৌর মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ তার নির্বাচিত মেয়াদ পার হয়ে আরেক মেয়াদ পার করতে যাচ্ছেন। কিন্তু সীমানা সংক্রান্ত আইনি জটিলতায় সেখানেও নির্বাচন হচ্ছে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এসব কারণে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট পৌরসভাগুলোর ওপর বিরক্ত। তাই সমস্যার সমাধানে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নতুন পৌরসভা গঠন ও বিদ্যমান পৌরসভা টিকিয়ে রাখতেও সংশ্লিষ্টদের কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে। দুই ক্ষেত্রেই প্রস্তাবিত সংশোধনের খসড়ায় কিছু কঠোর শর্ত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় যেসব পৌরসভা ১২ মাস অর্থাৎ এক বছরের বেশি বেতন-ভাতা বকেয়া রাখবে সেসব পৌরসভা বাতিল করার ক্ষমতা থাকবে সরকারের হাতে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসাবে পৌরসভার অন্যতম শর্ত নিজেদের আয় দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ পৌরসভা নিজেদের আয় দিয়ে চলতে পারে না।
করোনার মধ্যেও অনেক পৌরসভার কর্মচারীরা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করে বেতন-ভাতার দাবি করেন। এসব ঘটনায় সরকারকে বিব্রত হতে হয়। কারণ অনেক পৌরসভা নিজেদের সংস্থানের বাইরে অনেক লোক নিয়োগ দিয়ে দেয়। আর সাধারণ মানুষ পৌরসভাকে সরকারি প্রতিষ্ঠান ভেবে ঘুস দিয়েও কাজ নেন। এ ব্যবস্থা বন্ধ করতে উল্লিখিত কঠোর শর্ত আরোপ করা হচ্ছে।
বিদ্যমান পৌরসভা আইনে পুরোনো কিছু নিয়ম-কানুন ও শর্ত রয়ে গেছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমান পৌরসভাগুলোর প্রায় সবই প্রতি বর্গ কিলোমিটারে দুই হাজারের বেশি মানুষ বাস করেন। কিন্তু আইনে পৌরসভা হওয়ার শর্ত আছে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৫শ মানুষের। আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনে সেটা দুই হাজার জনের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে পৌরসভায় ‘সচিব’ পদটির নাম পরিবর্তনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সচিব পদটি দেশের প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ। একই নামে স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় পদের নাম রাখা হয়েছে।
পদের নামের মিল থাকায় অনেকে ‘সচিব’ শব্দটি ব্যবহার করে নানা প্রতারণার কৌশল নেয়। এ কারণে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন ও বিধি অনুবিভাগ থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাইরে আর কোনো প্রতিষ্ঠানে ‘সচিব’ পদ নাম ব্যবহার না করতে নির্দেশ দিয়েছিল। তারই আলোকে পৌরসভা আইনে সচিবের বদলে পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে নেত্রকোনা পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম রোববার রাতে যুগান্তরকে বলেন, এটা করা হলে আমলাতান্ত্রিক হাত শক্তিশালী হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসব পৌরসভায় নির্বাচন আটকে রাখা হয় সেটা তো অপকৌশল।
এ অপকৌশল কীভাবে সমাধান করা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কয়েকটি জায়গার সমস্যার কারণে সবার ওপরে এমন নিয়ম করে দেওয়াটা যৌক্তিক হবে বলে মনে করি না। এদিকে, আজকের মন্ত্রিসভায় চট্টগ্রাম বিভাগ উন্নয়ন বোর্ড অর্ডিন্যান্স, অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইনের খসড়া ওঠার কথা রয়েছে। এছাড়া ‘জবরদস্তি শ্রম সম্পর্কিত আইএলও কনভেনশন ১৯৩০’-এর প্রটোকল-২৯ অনুসমর্থনের প্রস্তাব উঠতে যাচ্ছে। এর বাইরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষিণ সুদান, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ইরান ও কাতার সফর সম্পর্কে অবহিতকরণের প্রস্তাব উঠবে।