সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার সহস্রাধিক প্রধান শিক্ষক তাদের প্রাপ্য টাইম স্কেল না পেয়ে হতাশ। একটি টাইম স্কেল পেলে একজন প্রধান শিক্ষকের বেতন এক ধাপ (গ্রেড) ওপরে যায়। ২০১৫ সালে সর্বশেষ জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকরের পর থেকে টাইম স্কেল উঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এসব শিক্ষকের পাওনা তার আগের। এ বাবদ সরকারের কাছে তাদের পাওনা হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা।
প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র থেকে জানা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা আগে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। শিক্ষকদের পদমর্যাদা বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ৯ মার্চ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড সরকারি কর্মকর্তার মযার্দা ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার দিন থেকেই তা কার্যকর করা হয়। পরের বছর ২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর নতুন জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর করা হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের ৯ জুন থেকে ২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশের প্রায় ৪১০০ প্রধান শিক্ষকের টাইম স্কেল প্রাপ্য। তারা এ পাওনা পেতে আবেদন করলেও অর্থ মন্ত্রণালয় আটকে দেয়।
সরকারি সব দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত টাইম স্কেল দেওয়া হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা তাদের চাকরির অষ্টম বছর পূর্তিতে প্রথম, ১২ বছরে দ্বিতীয় এবং ১৫ বছর পূর্তিতে তৃতীয় টাইম স্কেল পেতেন এতদিন। আটকে দেওয়ার কারণে ৪১০০ প্রধান শিক্ষক কারও প্রথম, কারও দ্বিতীয়; আবার কারও তৃতীয় টাইম স্কেল আটকে গেছে। এসব প্রধান শিক্ষকের টাইম স্কেল না দেওয়ার যুক্তি হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যেহেতু ২০১৪ সালের ৯ মার্চ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেহেতু এটি পদোন্নতি। ২০১৪ সালে পদোন্নতি হওয়ায় এ শিক্ষকরা ২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত টাইম স্কেল প্রাপ্য হন না।
অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, প্রধান শিক্ষকদের মর্যাদা ঘোষণা করা হলেও তাদের পদ ও বেতনের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তাই এটি কোনো পদোন্নতি নয়। সারাদেশের প্রধান শিক্ষকরাও বলছেন, ২০১৪ সালের ৯ মার্চ তাদের পদোন্নতি হয়েছে, বলা যাবে না। কারণ তাদের পদের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তারা প্রধান শিক্ষক ছিলেন, প্রধান শিক্ষকই আছেন। তাই তাদের টাইম স্কেল না দেওয়ার জন্য কোনো আইনগত যুক্তি নেই। প্রধান শিক্ষকরা এ ঘটনাকে ‘টাইম স্কেল ফাঁদ’ হিসেবে অভিহিত করছেন।
এই প্রধান শিক্ষকদের প্রাপ্য টাইম স্কেল প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. আকরাম আল হোসেন গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর অর্থ সচিবকে একটি পত্র দেন। সেখানে তিনি বলেন, প্রধান শিক্ষক পদটি বিধি অনুযায়ী একটি ব্লক পদ। এ পদ থেকে পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ তাদের শুধু গ্রেড ও পদমর্যাদা উন্নীত হয়েছে, কোনো পদোন্নতি হয়নি। পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিয়োগবিধির শর্ত অনুসরণ করে পদোন্নতি হতে হয় এবং এ জন্য প্রযোজ্য বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি/পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ প্রয়োজন। আর গ্রেড ও মর্যাদা উন্নীত হয় সরকারের নির্বাহী আদেশে। কাজেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ও পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীতের ফলে তাদের পদোন্নতি হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব (বাজেট-১) সিরাজুন নূর চৌধুরী কোনো কথা বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলম মুহম্মদ মনসুরুল আলম সমকালকে বলেন, কেবল প্রাপ্যই নয়, এটা এই শিক্ষকদের ন্যায্য পাওনা। আমি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালে এই প্রাপ্য তাদের দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি লিখেছি। এর যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি। এখনও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির খুলনা বিভাগীয় সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রধান শিক্ষকদের উন্নীত বেতন স্কেলের জটিলতা নিরসনে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। সে চিঠি মোতাবেক উচ্চতর গ্রেড/টাইম স্কেল পাওয়ার বিধান থাকলেও অজ্ঞাত কারণে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষকরা শুধু মর্যাদা পেয়েছেন, পদোন্নতি পেলে তো তারা সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার হতেন।
খুলনা প্রতিভাময়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লিপি আফরিন বলেন, ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রধান শিক্ষকদের উন্নীত বেতন স্কেলের জটিলতা নিরসনে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যে পত্র ইস্যু করা হয়, তা সংশোধন করে ২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর করার জোর দাবি জানাচ্ছি। রাঙামাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি রঞ্জিত ভট্টাচার্য মনি বলেন, প্রধান শিক্ষক পদটিকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার ঘোষণা দেওয়া হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা এখনও কোনো প্রধান শিক্ষক পাননি। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো গেজেটও জারি করা হয়নি। বরং ঘোষণাটির ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রধান শিক্ষকরা।
চুয়াডাঙ্গার আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও টাইম স্কেল বঞ্চিত কমিটির আহ্বায়ক স্বরূপ দাস সমকালকে বলেন, যেহেতু আমাদের নিয়োগকারী মন্ত্রণালয়ই বলছে, আমাদের পদটি ব্লক পদ এবং ২০১৪ সালে আমরা কোনো পদোন্নতি পাইনি, তাই আমাদের টাইম স্কেল দিতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। আর এ বছরের ৩ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আমাদের প্রধান শিক্ষক পদটিকে নন গেজেটেড হিসেবে ঘোষণা করেছে, তাই টাইম স্কেল দিতে আর কার্পণ্য করার অর্থ হয় না।