ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গো ভিলেজ থেকে ১২ কেজি ৩২০ গ্রাম অ্যামফিটামিন পাউডার উদ্ধার করা হয় গত বছর। এ সময় ‘হাতেনাতে’ গ্রেপ্তার করা হয় ছয়জনকে। পরে তাদের আসামি করে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) পরিদর্শক মো. হোসেন মিঞা। মামলাটি তদন্ত করেন একই অধিদপ্তরের পরিদর্শক ফজলুল হক খান। তিনি গত মার্চে এজাহারের ছয় অভিযুক্তসহ সাতজনকে বাদ দিয়ে নতুন করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। এজাহারের সব আসামিকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ায় মামলার নথি পর্যবেক্ষণ শেষে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের আদেশ দিয়েছেন। তবে ডিএনসিকে নয়, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাতে বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গো ভিলেজ থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, ঢাকা কাস্টমস ও এভসেক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল অ্যামফিটামিন পাউডার উদ্ধর করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুদ-উর-রহমান মামলাটির অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়- এজাহার ও চার্জশিট পর্যালোচনা করে লক্ষণীয় যে, এজাহারনামীয় ছয়জন এবং তদন্তে প্রাপ্ত মো. মাজেদকে অপরাধের সঙ্গে সংশ্নিষ্টতা না পাওয়ায় তাদের অব্যাহতির প্রার্থনা করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। তদন্তে প্রাপ্ত ১০ আসামির বিচার চাওয়া হয়েছে। এজাহারভুক্ত ছয় আসামিকে ঘটনাস্থল থেকে হাতেনাতে গ্রেপ্তারের কথা বলা হয়েছে এজাহারে। তাদের সামনেই সাক্ষীদের উপস্থিতিতে ১২ কেজি ৩২০ গ্রাম অ্যামফিটামিন পাউডার উদ্ধারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। কার্গোর ভেতর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাদের।
আদেশে আরও বলা হয়, তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই আসামির জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ এবং তা জুডিশিয়াল রেকর্ডে সংযুক্ত করেছেন। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় আসামির জবানবন্দি ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধের আইনগত ভিত্তি বা সুযোগ নেই। তদন্তকারী কর্মকর্তা এই সাতজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করলেও জব্দকৃত মাদকদ্রব্য সম্পর্কে আসামিদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জ্ঞান আছে কিনা, তা সুনির্দিষ্ট বক্তব্য উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন মর্মে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। চার্জশিটভুক্ত ৭, ৮ ও ৯ নম্বর আসামির বিরুদ্ধে কীসের ভিত্তিতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে, সেটিও সুস্পষ্ট নয়। চার্জশিটে ৯ নম্বর আসামির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু তা মাদক বিক্রির টাকা কিনা বা ওই আইনের ৩৬ ধারা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে কিনা আরও অধিকতর যাচাই-বাছাই হওয়া আবশ্যক। ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫৪ ধারার বিধান অনুযায়ী নিবিড় তদন্তের স্বার্থে এই মামলা অধিকতর তদন্ত হওয়া আবশ্যক বলে মনে করেন আদালত। পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
পিবিআই সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ইউসুফ সমকালকে বলেন, মামলাটির অধিকতর তদন্তের আদেশ তারা পেয়েছেন। গতকাল সোমবার মামলাটির নথিপত্র পিবিআইয়ে এসে পৌঁছেছে। মামলাটি সংশ্নিষ্ট ইউনিটে প্রেরণ এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। যে ছয় আসামিকে বাদ দেওয়া হয়েছে :অ্যামফিটামিনের চালানটি ফেডেক্স কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ায়। চালানটির সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া ছয়জন হলেন- ফেডেক্স বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) খন্দকার ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ এক্সপ্রেস কোম্পানির কর্মকর্তা রাসেল মাহমুদ, এমজিএইচ গ্রুপের লোডিং সুপারভাইজার কাজল টি গোমেজ, ইউনাইটেড এক্সপ্রেসের জেনারেল ম্যানেজার গাজী শামছুল আলম, কার্গো ভিলেজের হেলপার হামিদুল ইসলাম ও নজরুল ইসলাম। ছয়জনকে আসামি করে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তরের পরিদর্শক মো. হোসেন মিঞা বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করেন একই অধিদপ্তরের ঢাকা দক্ষিণের খিলগাঁও সার্কেলের পরিদর্শক ফজলুল হক খান। একই অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা এজাহারে বলেন, অ্যামফিটামিন পাচারে জড়িত হাতেনাতে এজাহারভুক্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরেক কর্মকর্তা, যিনি তদন্ত করলেন, তিনি বললেন অ্যামফিটামিনের সঙ্গে ওই ছয়জনের সংশ্নিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তদন্তে পাওয়া আরও একজন মাজেদের নাম বেরিয়ে আসে। তাকেও ওই এজাহারভুক্ত ছয়জনের সঙ্গে চার্জশিট থেকে বাদ দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ফজলুল হক খান।
ফজলুল হক খান সমকালকে বলেন, তদন্তে এজাহারভুক্ত ছয়জন ও মাজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। যে কারণে চার্জশিটে তাদের অভিযুক্ত করা হয়নি। তাহলে বাদীর এজাহার ভুল ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার তদন্তে এজাহারনামীয়দের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাদীর ভুল ছিল কিনা, সেটা বাদীকে জিজ্ঞেস করেন।’ মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য আদেশ দিয়েছেন আদালত- এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফজলুল হক বলেন, আদালত অধিকতর তদন্তের স্বার্থে পিবিআইকে তদন্ত করতে দিয়েছেন। আদালত যেটা মনে করেছেন, সেটা করেছেন। চার্জশিটভুক্ত ১০ জন :তদন্তে উঠে আসা ১০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয় আদালতে। চার্জশিটে বলা হয়েছে, মোহাম্মদপুর বছিলার জুনায়েদ ইবনে সিদ্দিকী ‘আইডিএস ক্রস ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার আড়ালে বিদেশে মাদক পাচার করেন। তিনি এক নম্বর অভিযুক্ত। চার্জশিটভুক্ত অপর ৯ জন হলেন- মিটফোর্ডের কেমিক্যাল ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ বান্টি, জুনায়েদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার নজরুল ইসলাম, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের লোডার শ্রমিক রুবেল হোসেন দেওয়ান, জুনায়েদের গাড়িচালক বাপ্পি হাসান, ভগ্নিপতি বাবুল মজুমদার, ব্যবসায়িক অংশীদার সতীশ কুমার সিলভারাজ, ফুফাতো ভাই দীন ইসলাম, স্ত্রী ফাতেমা তুজ জোহুরা এবং কুরিয়ার সার্ভিস ইউনাইটেড এক্সপ্রেসের কর্মচারী রেজাউল হক বাবুল।
এজাহারে যা বলা হয়েছে :গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর রাতে বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গো ভিলেজের ৩ ও ৪ নম্বর স্ক্যানিং কক্ষে শিপমেন্টের জন্য থাকা সাতটি কার্টনে গার্মেন্টস পণ্যের ভেতর থেকে ১২ কেজি ৩২০ গ্রাম অ্যামফিটামিন পাউডার উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এজাহারে উল্লেখ করা হয়- গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর রুবেল নামে এক ব্যক্তি উত্তরায় গাজী মো. শামছুল আলমের কার্যালয়ে সাতটি কার্টন নিয়ে যান। পরে শামছুল আলম মতিঝিলে ফেডেক্স কুরিয়ার সার্ভিসে রাসেল মাহমুদ ও খন্দকার ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমেদের কাছে কার্টনগুলো নিয়ে যান। এরপর রাসেল ও ইমতিয়াজ সেগুলো রপ্তানি কার্গো ভিলেজে পাঠিয়ে দেন। কাজল টি গোমেজ, হামিদুল ইসলাম ও কাজী নজরুল ইসলাম কার্গো হেলপার হিসেবে কার্টনগুলো শিপমেন্টের জন্য সহযোগিতা করেন।
মামলার বাদী ডিএনসির পরিদর্শক হোসেন মিঞা সমকালকে বলেন, ‘আমরা যাওয়ার আগে কার্গো ভিলেজ থেকে সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তারা তিনজনকে আটক করে রাখেন। আমাদের কাছে ওই তিনজনকে হস্তান্তর করেন তারা। তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অপর তিনজনকে গ্রেপ্তার করি আমরা।’ এজাহারের কেউ চার্জশিটভুক্ত হয়নি, তাহলে এজাহার কি ভুল ছিল- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা আমি বলব না। তবে তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তে প্রকৃত দোষীরা ধরা পড়েছে।’