ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো পথ এখনো তৈরি হয়নি। কীভাবে তারা ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন তারও কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রেফতার কোনো সমাধান নয়। কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি আলমাস কবীর ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পণ্য দিচ্ছে না, এটা সত্য। এখন এদের গ্রেফতার করে জেলে ভরলে তো গ্রাহক টাকা ফেরত পাবেন না। তার পরামর্শ হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের তরফ থেকে প্রশাসক বসিয়ে তাদের যে সম্পদ আছে তা বিক্রি করে সব টাকা দেওয়া না গেলেও যতটা সম্ভব গ্রাহকদের টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’
তবে অনেকে আবার এদের শাস্তিরও পক্ষে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘এই খাতে আস্থা ফেরাতে দোষীদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।’ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুরও মনে করেন, ‘যারা প্রতারণা করেছে, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এই ধরনের প্রতারণা সামনের দিনে ঘটতেই থাকবে।’ সর্বশেষ গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পণ্য ডেলিভারি করতে না পারার কারণে একজন গ্রাহকের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোছা. শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। কাস্টমার ও মার্চেন্টদের কাছে ই-কমার্স প্ল্যাটফরম ইভ্যালির প্রকৃত দেনার পরিমাণ ৫৪৪ কোটি টাকা। দায়ের বিপরীতে তাদের চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এ দুটির যোগফল মোট ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
এর আগে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক বনানী থানার ওসি তদন্ত শেখ সোহেল রানা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
‘নিরাপদ ডটকম’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকেও (সিইও) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শাহরিয়ার খান নামে ঐ ব্যক্তি ই-কমার্স সাইট খুলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়াও কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা গ্রেফতার হয়েছেন।
অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিরা গ্রেফতার হলেও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে এমনিতেই মানুষ আর্থিক সংকটে আছে। তার মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে ই-কমার্সে টাকা দিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে।
রফিকুল ইসলাম নামে একজন গ্রাহক বলেন, তিনি ইভ্যালির মাধ্যমে প্রায় ৪ লাখ টাকা দিয়েছেন কিছু পণ্য কেনার জন্য। এখন পণ্যও পাননি, টাকাও পাননি। এই টাকা না পাওয়ায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। আমিরুল ইসলাম নামে একজন জানিয়েছেন, ১ লাখ ৮০ হাজার মোটরসাইকেল ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় পাওয়ার অফারে তিনি টাকা দিয়েছেন। এখন টাকাও গেল, মোটরসাইকেলও পেলেন না। অনেক কষ্ট করে এই টাকা জোগাড় করেছিলেন। প্রতারণার শিকার হতে পারেন জানার পরও কেন টাকা দিয়েছিলেন জানতে চাইলে আমিরুল বলেন, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। করোনার কারণে চাকরি চলে গেছে। রাইড শেয়ারিংয়ে চালানোর জন্য মোটরসাইকেলটি কিনতে চেয়েছিলেন। ধার করে ঐ টাকা দিয়েছিলেন। এখন পথে বসে গেলেন।
এমন অসংখ্য মানুষ ই-কমার্সে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের উপ-কমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া ইত্তেফাককে বলেছেন, এখন ই-কমার্সে অভিযোগের পরিমাণ আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব প্রতিকারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে বিতর্কের মুখে রয়েছে ইভ্যালি। তার পরও কেন গ্রাহকেরা সেখানে আস্থা রেখেছে, জানতে চাইলে গ্রে অ্যাডভার্টাইজিংয়ের বাংলাদেশের কান্ট্রি হেড গাউছুল আযম শাওন ইত্তেফাককে বলেন, ‘নামকরা প্রতিষ্ঠান যখন তাদের বিজ্ঞাপন করে, তখন মানুষ কেন আস্থা রাখবে না? নাম করেই যদি বলি, দুই দিন আগেও বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের স্পন্সর ছিল ইভ্যালি। আমাদের ক্রিকেটাররা ইভ্যালি লেখা জার্সি গায়ে জড়িয়ে যখন মাঠে নামেন, তখন সাধারণ মানুষের কাছে কী বার্তা যায়?’ বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো দায় আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন করলে সেই প্রোডাক্ট সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। সেটা মডেলকেও জানাই।’
বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন কেন করেন তারকারা, জানতে চাইলে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এমপি ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমি যদি জানতাম ই-অরেঞ্জ প্রতারণা করবে, তাহলে কি আর তাদের শুভেচ্ছা দূত হতাম? এগুলো আসলে আমাদের জানার সুযোগ নেই। কেউ কি বলে আমি প্রতারণা করব, আপনি আমাদের দূত হন?’ কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন করার আগে সেই পণ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে মাশরাফি বলেন, ‘তাহলে তো আপনাকে মালিকানায় ঢুকতে হবে। ম্যানুফেকচার যেখানে হচ্ছে, সেখানে যেতে হবে। কোম্পানির সিইও যারা থাকে বা শেয়ারহোল্ডার যারা থাকে, তারা খোঁজখবর রাখতে পারে। যারা এই বিজনেসটা করছে এটা তাদের বিষয়। শুভেচ্ছা দূতের কাজ হচ্ছে, আপনি আমাদের কোম্পানির শুভেচ্ছা দূত, আপনার সঙ্গে এত টাকার চুক্তি, আপনি ছয় মাসে তিন দিন, বছরে ছয় দিন সময় দেবেন। সারা পৃথিবীতে এটাই প্রচলিত। আপনি ধরেন একটি মুদি দোকান দিতে হলেও লাইসেন্সের দরকার হয়। লাইসেন্স তো কোনো শুভেচ্ছা দূত দেন না। ফলে যারা লাইসেন্স দেন, এটা দেখা তাদের দায়িত্ব।’
এর আগেও ডেসটিনি, যুবক, নিউওয়ে, জিজিএনসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে লাখ লাখ গ্রাহক প্রতারিত হয়েছিলেন। তারাও এখন পর্যন্ত তাদের বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাননি। ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরাও গ্রেফতার হয়ে এখনো জেলে আছেন।