জার্মান জাতির সঙ্গে বাঙালির বন্ধুত্বের ইতিহাস শত বছরের। সংস্কৃতির এই বন্ধনকে ‘সেঞ্চুরি-ওল্ড’ বলছে উইকিপিডিয়া। জার্মানদের কাছে বাংলাদেশ নাম ভূখণ্ডের স্বতন্ত্র পরিচিতি রয়েছে। এ অঞ্চলের বহু গুণী পর্যটক জার্মানি যেমন ঘুরেছেন, তেমনি জার্মানরাও এখানে এসেছেন যখন-তখন। দুই জাতির পারস্পরিক যোগাযোগে আজ রচিত হয়েছে সংস্কৃতি বিনিময়ের সমৃদ্ধ ইতিহাস। পূর্ব জার্মানিই ইউরোপের প্রথম রাষ্ট্র যারা নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বিজয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছিল। প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র ভুটান ও ভারতের পর জার্মানির সেই স্বীকৃতির পথ ধরেই ইউরোপ তথা বৈশ্বিক সমর্থন-স্বীকৃতি পেয়েছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। পুরনো বন্ধু জার্মানির (বর্তমানে পূর্ব-পশ্চিম একীভূত) সঙ্গে অনেকটা নীরবেই বিদ্যমান সম্পর্ককে ‘স্ট্র্যাটেজিক লেভেল’ বা ‘কৌশলগত পর্যায়ে’ উন্নীত করেছে বাংলাদেশ।
বিশ্বের খুব কম দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ এমন সম্পর্ক গড়েছে। রেকর্ড বলছেÑ হাই প্রোফাইল ভিজিট বা বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিকতায় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ অন্যদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন অবিধায় সম্পর্কের রূপান্তর ঘটিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু পুরনো বন্ধু জার্মানির সঙ্গে তা হচ্ছে অনেকটা নিঃশব্দে। অতি সম্প্রতি পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বার্লিন সফর করেছেন। তিনি সেখানে প্রথমবারের মতো দ্বিপক্ষীয় ‘স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ’ করেছেন। সেই সংলাপে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বেশকিছু বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। যার মধ্যে ছিল- জলবায়ু পরিবর্তন, ব্লু ইকোনমি, জঙ্গিবাদ দমন, সাইবার নিরাপত্তা, মানব ও মাদক পাচার, অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো, জার্মানি থেকে নথিবিহীন বাংলাদেশিদের ফেরত আনা, আফগানিস্তান পরিস্থিতি, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, রোহিঙ্গা ইস্যু, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, কানেকটিভিটি এবং আঞ্চলিক সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই), জাপানের প্রস্তাবিত বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ ইনিশিয়েটিভ (বিগ-বি) এবং বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল চতুর্দেশীয় (উপ-আঞ্চলিক) যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বিবিআইএন ইত্যাদি। ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, জার্মানির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের রূপান্তরের একটি বিশেষ প্রেক্ষাপট রয়েছে। তা হলো- ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বেরিয়ে যাওয়ার (ব্রেক্সিট) পর ২৭ রাষ্ট্রের ওই জোটে জার্মানিই সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র।
তাছাড়া ইউরোপে এককভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার হচ্ছে জার্মানি (সর্বোচ্চ রপ্তানির গন্তব্য)। বৈশ্বিক বিবেচনায় দ্বিতীয় অর্থাৎ আমেরিকার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি হয় জার্মানিতে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। দেশটির প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলারের ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে ঢাকায়। সার্বিক বিবেচনায় জার্মানির সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় করার ওই উদ্যোগ। এটি পরোক্ষভাবে ইইউ জোটের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ। কর্মকর্তারা ধারণা দিয়েছেন, জার্মানির পথ ধরে ইউরোপের অন্য প্রভাবশালী রাষ্ট্র ফ্রান্স ও ইতালির সঙ্গেও সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। বলা হচ্ছে- স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে গতানুগতিক ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি)’র বদলে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সংলাপ বা কম্প্রিহেনসিভ সংলাপ চাইছে বাংলাদেশ, বিশেষ করে ইউরোপের সঙ্গে।