দেশের বাজারে নির্মাণকাজের অন্যতম প্রধান উপকরণ রডের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। দফায় দফায় বেড়ে এই পণ্যের দাম এখন ওয়ান-ইলেভেনের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। রডের পাশাপাশি নির্মাণকাজে প্রয়োজনীয় আরেক উপকরণ সিমেন্টের দামও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। রাজধানীর খুচরা ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ওয়ান-ইলেভেনের (২০০৭ সালের জানুয়ারির পর) সময় দেশজুড়ে দেখা দেয়া অনিয়শ্চয়তার মধ্যে ভালো মানের (৬০ গ্রেডের ওপরে) এক টন রডের দাম ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। এটাই দেশের বাজারে এখন পর্যন্ত রডের সর্বোচ্চ দাম। সম্প্রতি রডের দাম বেড়ে ওই সময়কার কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ভালো মানের এক টন রড কোম্পানিভেদে এখন খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায়।
রডের এই দাম বাড়ার কারণে হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে নির্মাণ কাজে এক প্রকার স্থবিরতা নেমে আসে। তবে কয়েক মাস ধরে রডের বিক্রি বেড়ে গেছে। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রডের দামও বেড়েছে। রড উৎপাদকরা বলছেন, দেশের বাজারে যে রড উৎপাদন হয় তার সিংহভাগ কাঁচামাল আনতে হয় বিদেশ থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে রডের কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। এমনকি চাহিদার তুলনায় কাঁচামালের ঘাটতিও রয়েছে। মূলত কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে রডের দাম বেড়ে গেছে।
এদিকে রডের পাশাপাশি গত এক সপ্তাহে সিমেন্টের দামও বেড়েছে। কোম্পানিভেদে বস্তাপ্রতি সিমেন্টের দাম বেড়েছে ১০-৫০ টাকা পর্যন্ত। সামনে সিমেন্টের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। আর সিমেন্ট উৎপাদকরা বলছেন, কাঁচামাল ও জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়াই সিমেন্টের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। এর সঙ্গে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া দাম বাড়ার একটি কারণ।
পুরান ঢাকার নওয়াব ইউসুফ রোডের ইসলাম অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক তিয়াস বলেন, ‘করোনার শুরুর দিকে কয়েক মাস আমাদের বিক্রিই ছিল না। তবে দুই-তিন মাস ধরে বিক্রি ভালো হচ্ছে। বিক্রি বাড়ার পাশাপাশি রডের দামও বেড়ে গেছে। সব কোম্পানির রডের দাম টনপ্রতি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।’রডের দাম বাড়ার বিষয়ে একই ধরনের তথ্য দেন পুপুল স্টিল করপোরেশনের মালিক তনু। তিনি বলেন, ‘রডের দাম গত অক্টোবর থেকেই বাড়তি। মাঝে দাম কিছুটা কমে ছিল। কিন্তু চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মাসখানেক ধরে রডের দাম নতুন করে আরও বেড়েছে।’
মেট্রো ট্রেডার্সের মালিক সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, ‘করোনার মধ্যে আমাদের খুব খারাপ পরিস্থিতি গেছে। মাঝে কিছুটা ভালো ব্যবসা হয়েছে। তবে রডের দাম বাড়ার কারণে এখন আবার ব্যবসা ডাউন। ক্রেতা না থাকায় বেশিরভাগ সময় দোকানের কর্মীরা অলস সময় কাটাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে এখানে ব্যবসা করছি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় এক টন রডের দাম ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সময়টা বাদ দিলে এখনই দেশের বাজারে রডের সবচেয়ে বেশি দাম। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ছাড়া এত বেশি দামে আর কখনো রড বিক্রি হয়নি।’
সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, ‘এক সময় আমাদের এখানে রডের ব্যবসা খুব জমজমাট ছিল। দিন দিন সেই চিত্র বদলে যাচ্ছে। আগে এখানে রডের দোকান ছিল তিনশ’র মতো। এখন তা কমতে কমতে দেড়শর মতো আছে। ব্যবসার যে অবস্থা সামনে এ দোকানগুলো থাকবে কি-না সন্দেহ আছে। সিমেন্টের দাম বাড়ার বিষয়ে রামপুরার মেসার্স মামুন ট্রেডিং করপোরেশনের ম্যানেজার মো. বাবুল বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে কোম্পানিভেদে সিমেন্টের দাম প্রতি বস্তায় ১০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। এতে এখন কোম্পানিভেদে এক বস্তা সিমেন্ট ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিমেন্ট কোম্পানির লোকেরা যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে দুই-একদিনের মধ্যে সিমেন্টের দাম প্রতি বস্তায় আরও ১০-২০ টাকা বেড়ে যেতে পারে।’
সিমেন্টের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আরামিট সিমেন্টের কোম্পানি সচিব সৈয়দ কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিমেন্টের দাম বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া। বিশ্ববাজারে সিমেন্টের কাঁচামালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে জাহাজ ভাড়াও বেড়েছে। এসব কারণেই এখন সিমেন্টের দাম বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণত যখন বৃষ্টি থাকে না, সে সময় নির্মাণকাজ বেশি হয়। এতে সিমেন্টের চাহিদাও বাড়ে। সেই হিসেবে এখন বাজারে সিমেন্টের ভালো চাহিদা রয়েছে। তবে দাম বাড়ার পেছনে এই চাহিদা বাড়ার সম্পর্ক নেই। মূলত কাঁচামাল ও জাহাজ ভাড়া বাড়ার কারণে সিমেন্টের দাম বেড়েছে।’সিমেন্টের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় এমআই সিমেন্টের কোম্পানি সচিব মো. মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সিমেন্টের দাম বেড়েছে। তবে কী কারণে বাড়ছে এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’
রডের দাম বাড়ার বিষয়ে বিএসআরএম স্টিলের কোম্পানি সচিব শেখর রঞ্জন কর জাগো নিউজকে বলেন, ‘রডের দাম বাড়ার একমাত্র কারণ বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া। করোনার কারণে রডের কাঁচামাল সরবরাহে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এখনো তার প্রভাব রয়ে গেছে। বাজারে কাঁচামালের যে চাহিদা রয়েছে, তার তুলনায় মালের ঘাটতি রয়েছে।’
আরএসআরএম স্টিলের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ মইন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রডের দাম ডিসেম্বরে এক দফা বাড়ে। মাঝে কিছুটা কমলেও সপ্তাহখানেক ধরে আবার দাম বেড়েছে। একটি পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে, এখন রডের দাম বাড়ার ক্ষেত্রেও অনেকগুলো কারণ আছে। তবে রডের দাম বাড়ার মূল কারণ স্টেপ (রডের কাঁচামাল)।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্টেপের দাম বেড়ে গেলে রডের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী দীর্ঘদিন স্টেপ সরবরাহ বন্ধ ছিল। বন্ধ থাকার কারণে স্টেপ সেভাবে পাওয়া যায়নি। এমনকি যারা স্টেপ নিজেরা বিক্রি করে, তারাও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে স্টেপ কিনেছে। যে কারণে ২৫-২৬ হাজার টাকার স্টেপের দাম ৪০-৪৫ হাজার টাকা হয়ে যায়। স্টেপের এমন দাম বাড়ার কারণেই রডের দাম বেড়েছে।’
রডের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে চাহিদা কোনো প্রভাব ফেলেছে কি-না জানতে চাইলে মইন উদ্দিন বলেন, ‘রডের দাম বাড়ার পেছনে চাহিদা বাড়ার একটি প্রভাব থাকতে পারে। তবে সেটা খুব বড় কারণ নয়। কারণ আগে বৃষ্টিতে কাজ হতো না, কিন্তু এখন সেই চিত্র বদলে গেছে। দেশের ভেতরে সারাবছরই নির্মাণকাজ হয়, শুধু ভারী বর্ষার সময় হয়তো কাজ বন্ধ থাকে। এরপরও খরার মৌসুমে রডের চাহিদা কিছুটা বেশি থাকে। এখন যেমন রডের ভালো চাহিদা রয়েছে।’