গত মাসের শেষ দিন, অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারি দেশে দৈনিক করোনা শনাক্তের হার ছিল দুই দশমিক ৮৭ শতাংশ। কিন্তু, মার্চের শুরু থেকে আবারও দৈনিক শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শুক্রবারের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার চার দশমিক ৬৩ শতাংশ। এই সময়ে ১৩ হাজার ৭১০টি নমুনা পরীক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত আরও ৬৩৫ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
এর মধ্যে গত ১ মার্চ শনাক্তের হার ছিল চার দশমিক ৩১ শতাংশ, ২ মার্চ তিন দশমিক ৩৬ শতাংশ, ৩ মার্চ তিন দশমিক ৭৪ শতাংশ ও ৪ মার্চ ছিল তিন দশমিক ৮৭ শতাংশ। করোনা শনাক্তের ঊর্ধ্বমুখী হার ও বর্তমানে করণীয় নিয়ে কথা বলেছে তিন জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে এবং তা আমরা খেয়াল করছি। আমরাও পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। এখানে কয়েকটি জিনিসকে আমরা মাথায় নিয়ে আসছি। একটা হলো— শীতের সময় বাংলাদেশসহ উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে সংক্রমণ কমে গিয়েছিল। কিন্তু, শীতপ্রধান দেশগুলোতে এ সময়ে সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছিল। একটা বিষয় আমরা জানি যে, শীতপ্রধান দেশগুলোতে শীতকালে ইনফ্লুয়েঞ্জা বেড়ে যায়। আর গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে বাড়ে গরমকালে। তাই যেহেতু আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশ, তাই এ সময়ে করোনার সংক্রমণ বাড়বে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। আরেকটু পরে আমরা সেটা বুঝতে পারব। গত বছর মার্চে দেশে সংক্রমণ শুরু হলো। কিন্তু, মে-জুন-জুলাইয়ে যখন আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি গরম পড়ছিল, তখনই আমরা দেখেছি যে সংক্রমণ বেড়েছে। এবারই তাই ঘটছে কি না, তা বোঝা যাবে আরও একটু সময় পরে। কারণ, অনুরূপ ঘটনাই ঘটেছে ভারত, নেপালসহ গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে।’
‘আরেকটি জিনিস আমরা ভাবছি যে, করোনার যেই ভ্যারিয়েন্টগুলো দ্রুত ছড়ায়, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টটা, আমার মনে হয় সেটা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেটা ভারত-নেপালেও আছে। এসব দেশের অনেকেই ব্রিটেনে থাকেন এবং গত কয়েক মাসে ব্রিটেন থেকে অনেকেই দেশে এসেছেন। তারা ঠিকমতো কোয়ারেন্টিন মানেনি। অনেকেই কোয়ারেন্টিন মানলেও যথাযথভাবে মানেনি। ওই ভ্যারিয়েন্টটা যদি দেশে এসে থাকে, যেহেতু সেটা দ্রুত ছড়ায়, সেটার প্রভাব পড়ছে কি না, তা নিয়েও আমরা উদ্বেগে আছি’, বলেন তিনি।
বর্তমানে করণীয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে কোন ভ্যারিয়েন্টটা আছে, তা জানা দরকার। সেজন্য জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে। সরকারের উচিত পরিস্থিতি হালকাভাবে না নিয়ে ঘোষণা দিয়ে দেওয়া যে, বাংলাদেশে সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে, এটা উদ্বেগের এবং আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই ঘোষণা আসাটা এখন জরুরি। এটা আসলে সুবিধা হবে যে— ট্রেসিং, টেস্টিং, যথাযথভাবে কোয়ারেন্টিন পালন নিশ্চিত করাসহ সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নেবে। যেসব দেশে মারাত্মক ভ্যারিয়েন্ট আছে, সেসব দেশ থেকে লোক আসাও বন্ধ রাখতে হবে। একান্ত কারো আসতে হলে কঠোর কোয়ারেন্টিন মেনে আসতে হবে।’
‘সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। আর মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নেই। আবারও মাস্ক পরার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। হাত ধুতে হবে। যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে যাচ্ছে, এখনো সময় আছে, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে’, যোগ করেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘যখন সারাবিশ্ব থেকে করোনা বিদায় হবে, তখনই আসলে এটা নিয়ন্ত্রণ হবে। কিন্তু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, টানা দুই সপ্তাহ যদি সংক্রমণ পাঁচের নিচে থাকে, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে। তখন বোঝায় যে, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন আর নেই। তখন হয়ে যায় গুচ্ছভিত্তিক সংক্রমণ বা ক্লাস্টার ট্রান্সমিশন। কিন্তু, যদি আবার সংক্রমণের হার বেড়ে পাঁচের বেশি হয়ে যায়, তখন আবার আমরা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের চলে যাব। কাজেই ঢিলেঢালাভাবে চলার সুযোগ নেই।’
‘করোনার সংক্রমণ কমে গেলেও সেটা আবার বাড়ার পরিপূর্ণ আশঙ্কা থাকে। সারাবিশ্বেই সেটা হয়েছে। বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ আমরা একেবারে শূন্যের কোটায় তো যেতেই পারিনি। কাজেই আমাদের শিথিল বা সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের এখানে সংক্রমণের হার খুব বেশিদিন তিনের নিচে ছিল না। এখন আবার সেটি বেড়ে পাঁচের কাছাকাছি আছে। কাজেই আবারও আমরা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের দিকে চলে যাচ্ছি’, বলেন তিনি।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করে আইইডিসিআরের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ভ্যানটিলেশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আর সর্বোপরি ভ্যাকসিন নিতে হবে। করোনার সংক্রমণ কমানোর ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন আমাদের জন্যে নতুন হাতিয়ার। মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে ভ্যাকসিন সবচেয়ে বড় অবদান রাখবে। ভ্যাকসিন নিলেও সংক্রমণ হয়তো থাকবে, কিন্তু, সেটা প্রাণঘাতী জায়গায় যাবে না।’
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘এই যে সংক্রমণ কমছে, আবার বাড়ছে, বৈজ্ঞানিকভাবে এটার ব্যাখ্যা দেওয়াটা বেশ কঠিন। তা এখনই দেওয়া যাবে না। এর জন্যে আরও অপেক্ষা করতে হবে কিংবা আরও পরীক্ষা করতে হবে। আর সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে বলতে গেলে, অনেকেই ভ্যাকসিন নিচ্ছেন। অনেকেই নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেটা ভালো দিক। কিন্তু, লোকজন স্বাস্থ্যবিধিগুলো ঠিক ওইভাবে মানছে না। অনেকের মাঝে ঢিলেঢালা ভাব চলে এসেছে। কিন্তু, তা উচিত নয়। স্বাস্থ্যবিধিগুলোও এখনো আমাদেরকে মানতে হবে। সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’