দেশের চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ১৪৮ জন আফগান শিক্ষার্থীকে কাবুল থেকে বের করে আনার মিশন যেন সিনেমার প্লটের মতোই রোমাঞ্চকর। গত জুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে আফগান শিক্ষার্থীরা নিজ দেশে যান। এর মধ্যে তালেবান আফগানিস্তান দখল নিলে সেখানে আটকা পড়েন তারা।
আফগান শিক্ষার্থীদের কাবুল থেকে বের করে আনার জন্য সেপেহরাকে দলনেতা করে সাত জনের একটি দলকে সার্বিক সমন্বয় ও যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল নির্দিষ্ট একটি সময়ে পূর্বনির্ধারিত স্পটে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদের বাসে উঠিয়ে বিমানবন্দরে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল।
একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তারা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ব্যবহার করেন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের ফেরাতে মোট সাতটি বাস ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রতিটি বাসে একজন নিরস্ত্র গার্ড ও একজন চালক ছিলেন। তাদেরকে চেকপয়েন্টে আলোচনা করে ক্লিয়ারেন্স নিশ্চিত করতে বলা হয়। বাসগুলোতে পর্যাপ্ত পানি, খাবার ও পাওয়ার ব্যাংক মজুদ করা হয়।
তাৎক্ষণিক ভাবে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব পরে শিক্ষার্থীদের দলনেতা সেপেহরার ওপর। তিনি ফ্রু, বাটুল, সাবিরা, হুমাইরা, নিয়াব ও সামিরাকে নিয়ে গঠিত ছয় সদস্যের দলের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতেন।
তিন শিক্ষার্থীর ফ্লাইট মিস
কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সবগুলো চেকপয়েন্ট দিয়ে পাঁচ বার ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন তারা। অবশেষে যখন ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় তখন শিক্ষার্থীদের কাছে এটি ছিল অবিশ্বাস্য।
আতঙ্কিত ও ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিন জন সে সময় বিমানবন্দরে মানুষের ভিড় থেকে দূরে সরে যান। মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়ার জন্য বিমানবন্দরের অন্য একটি রুমে গিয়ে একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঠিক সেই সময়ই তাড়াহুড়ো ও বিভ্রান্তির মধ্যে দলের বাকি ১৪৫ শিক্ষার্থী মধ্যপ্রাচ্যে একটি মার্কিন বিমান ঘাঁটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।
ঘুম ভেঙে ওই তিন শিক্ষার্থী যখন জানতে পারেন বাকিরা চলে গেছে, তখন নিরুপায় হয়ে তাদেরকে বিমানবন্দরেই পড়ে থাকতে হয়। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দলনেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা। অবশেষে ডিরেক্ট রিলিফ নামের একটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী বন্ধু তাদের সঙ্গে দেখা করতে সক্ষম হয়। এই সংগঠনটি ন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে কোভিড-১৯ এর সামগ্রী সরবরাহ করতো। পরে ওই তিন শিক্ষার্থী দোহার একটি ফ্লাইটে ওঠেন। দোহায় পৌঁছে তারা বাকিদের খুঁজতে থাকেন। কিন্তু সেখানে আর কেউই ছিল না। পরে তারা জানতে পারেন, বাকি ১৪৫ জন শিক্ষার্থী রিয়াদে গেছেন।
মিশন সফল
কাবুল বিমানবন্দরে প্রায় ৪০ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর ১৪৮ জন শিক্ষার্থীই গত শনিবার মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছেছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি কামাল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি দলকে মার্কিন সামরিক উড়োজাহাজে করে কাবুল থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে। তারা এখন নিরাপদে মধ্যপ্রাচ্যের ঘাঁটিতে পৌঁছেছেন।’
তিনি বলেন, ‘অসাধারণ কিছু মানুষ প্রায় অলৌকিক এই কাজটি করতে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। তাদের সেই অবদান আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করবো। সাতটি বাসে করে ওই দলটিকে দুবার কাবুল বিমানবন্দরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফ্লাইট না ছাড়ায় তাদের ফিরে যেতে হয়। ৪০ ঘণ্টা সময় তাদের পার করতে হয় সেই বাসের ভেতরই। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় দফার চেষ্টা সফল হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীদের দলনেতা সেপেহরা এবং আরও ছয় জন সার্বিক সমন্বয় ও যোগাযোগের কাজে সহযোগিতা করেছে। তারা সেই যোগ্যতা ও দৃঢ়তা দেখিয়েছে যাকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বর্ণনা করে গেছেন “গ্রেস আন্ডার প্রেশার” হিসেবে। তাদের প্রত্যেকের প্রতি আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।’
‘আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তারা হাল ছেড়ে দেবে না। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, অন্য এক আফগানিস্তানের ধারণাকে আমরা সমর্থন দিয়ে যাবো। হয়ত সেই বাস্তবতায় এখনও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, কিন্তু আল্লাহ চাইলে একদিন তা সম্ভব হবে। সেপেহরা আর অন্য যাদের এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটি বিগত কয়েক বছর ধরে শিক্ষা দিয়ে আসছে, সেই মেয়েরাই একদিন সেই আফগানিস্তানকে বাস্তবে পরিণত করবে। সেই দিন একদিন আসবেই,’ যোগ করেন কামাল আহমেদ।
গত ৩০ জুন ওয়েবসাইটের এক বার্তায় তিনি লেখেন, ‘সম্ভবত আমাদের (বাংলাদেশের) সম্প্রদায়ের মধ্যে আর কেউ আফগান শিক্ষার্থীদের মতো চরম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে না। আফগান ভূখণ্ড থেকে ন্যাটো বাহিনী দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর তালেবানরা ইতোমধ্যেই একশরও বেশি জেলা দখল করে নিয়েছে। কাবুলের জন্য যা অপেক্ষা করছে তার ভয়ও এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তালেবান কেমন আচরণ করতে পারে এ নিয়ে আমাদের কোনো বিভ্রম নেই। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও এটি খুব ভালো করেই বোঝেন। এই পরিস্থিতিতে আমরা কেবল আমাদের বর্তমান শিক্ষার্থীই নয়, আফগানিস্তান থেকে যারা আগে আমাদের এখানে পড়েছেন তাদেরও সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তাদের মধ্যে যারা আবার স্নাতক পর্যায়ের কোনো কোর্সে আসতে চান, ভবিষ্যতে নিজের দেশে ফিরে সুন্দর জীবন গড়তে চান, তাদেরও আমরা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি জানাতে পেরে আনন্দিত যে, গতকাল আমরা সেই মিশনটি সফলভাবে শেষ করতে পেরেছি।’