আগামী বছরের বিজয় দিবসের আগেই বহুল প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেল যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার দিনক্ষণ স্থির করেছে সরকার। এ তিন বৃহৎ প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে অর্থায়নের ব্যাপারে যেন কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি না হয় সে বিষয়েও অর্থ বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পরের বছরের বিজয় দিবসের আনন্দকে আরও উপভোগ্য ও স্মরণীয় করতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এজন্য প্রযুক্তিবিদ, প্রকৌশলী, নির্মাণশ্রমিক, অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টরা বিরতিহীনভাবে পালা করে কাজ করছেন এসব প্রকল্পে। বর্তমানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় এ সময়টাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর নির্দেশও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থ বিভাগ, সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এদিকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজে সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯৪ ভাগ। আগস্ট শেষে এটা ৯৬ ভাগ হওয়ার আশা করা হচ্ছে। এ সেতুর সড়কপথের শেষ স্লাব ইতিমধ্যে বসানো হয়েছে। আগামী অক্টোবরে শুরু হবে পিচ ঢালাইয়ের কাজ। বন্দরনগর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মীয়মাণ টানেলের কাজ জুলাই পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। আগস্ট শেষে এটা ৭৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ার আশা করা হচ্ছে। টানেলের নির্মাণকাজ শেষ হলে কর্ণফুলী নদীর আনোয়ারা অংশে অর্থাৎ দক্ষিণ চট্টগ্রামে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ইকোনমিক জোন গড়ে উঠবে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে মেগা সিটি ঢাকার তথা দেশের প্রথম মেট্রোরেল লাইন-৬-এর দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও অংশের কাজ সমাপ্ত হতে আর ছয় মাস লাগবে। ৩১ জুলাই পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৬৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর উত্তরা থেকে মিরপুর (আগারগাঁও) পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৮৮ শতাংশ। আগস্ট শেষে এটা ৯০ শতাংশের বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকায় অন্য আরও পাঁচটি মেট্রোরেল লাইনের কাজ শুরু হয়েছে, যেগুলোর কাজ ধাপে ধাপে সমাপ্ত হবে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ। এ প্রসঙ্গে মেট্রোরেলের ট্রায়াল উদ্বোধনের সময় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী বছর তিনটি মেগা প্রজেক্ট উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জুনে পদ্মা সেতু, পরে কর্ণফুলী টানেল ও বছর শেষে তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নের মেট্রোরেল লাইন-৬ উদ্বোধন করা হবে। তবে সেতু বিভাগ সূত্র জানান, আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যেই এ তিনটি প্রকল্প সমাপ্ত করা হবে। যদিও মেট্রোরেল লাইন-৬ নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েছে। অবশ্য পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধনের সময়সীমা এখন পর্যন্ত ঠিকই আছে। সব ঠিক থাকলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পরের বছর হিসেবে আগামী বছরের জুনে পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হবে। এরপর একে একে কর্ণফুলী টানেল ও মেট্রোরেল খুলে দিয়ে ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উদ্্যাপন করা হবে এ তিনটি প্রকল্প উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে।
এ প্রসঙ্গে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ধাপই সুচারুভাবে সম্পন্নের চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে করোনার সংক্রমণ কমে আসায় আগের ক্ষতিও পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিক ট্রায়াল শুরু হয়েছে। আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করে নগরবাসীকে রেলে চড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছি।’
মেট্রোরেলের অগ্রগতি : ইতিমধ্যে মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক ট্রায়াল শুরু হয়েছে। এ ছাড়া এ প্রকল্পে ২৭ কিলোমিটার রেল ট্র্যাকের কাজ দৃশ্যমান হয়েছে। প্রকল্পের প্রথম অংশ উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মিরপুর (আগারগাঁও) অংশের অগ্রগতি ৮৭ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিলের অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুসরণে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করার জন্য বর্তমানে ডিটেইল ডিজাইন ও ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের অগ্রগতি ৫৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ডিএমটিসিএল জানায়, ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার ভায়াডাক্টের মধ্যে ১৩ দশমিক ২৭৫ কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়েছে। প্যাকেজ-০৭-এর আওতায় ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেমের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। উত্তরা ডিপোয় রিসিভিং সাবস্টেশনের পূর্তকাজ শেষ করে বিদ্যুতায়নের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মতিঝিল রিসিভিং সাবস্টেশনের ভবন নির্মাণকাজ চলমান। ডিপো এলাকার ওয়ার্কশপ শেডের অভ্যন্তরে ১২টি রেললাইনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। স্ট্যাবলি শেডের অভ্যন্তরে এবং সংলগ্ন ইয়ার্ডে ১৯টি ব্যালাস্টেড রেললাইনের মধ্যে সব রেললাইনের স্থাপন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভায়াডাক্টের ওপর মেইন লাইনের ২ হাজার ৬৭৮টি লে জয়েন্ট ওয়েল্ডিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগারগাঁও পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক লাইনের মধ্যে সাড়ে ১৭ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক অ্যালাইনমেন্টের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন কাজ চলমান। এদিকে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী ও মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনের ছাদের ঢালাই দেওয়া হয়েছে। মিরপুর-১১, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া এবং আগারগাঁও স্টেশনের ছাদ নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ ও পল্লবী স্টেশনের স্টিলের ছাদ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। মিরপুর-১১ স্টেশনের ছাদ নির্মাণকাজ চলমান।
কর্ণফুলী টানেলের অগ্রগতি : চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে দেশের ইতিহাসে প্রথম টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। এ টানেলের নামকরণ হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। জুলাই পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগস্ট শেষে এর কাজ ৭৫ শতাংশ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের (জি টু জি) যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ আর চীন সরকারের ঋণ ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে নদীর দুই প্রান্তে থাকবে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এ ছাড়া ৭২৭ মিটার দীর্ঘ একটি ফ্লাইওভার আছে আনোয়ারা অংশে।
পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি : পদ্মা সেতু প্রকল্পের সামগ্রিক অগ্রগতি হয়েছে ৯৪ শতাংশ, যা আগস্ট শেষে ৯৬ ভাগ সম্পন্ন হওয়ার আশা করা হচ্ছে। এ সেতুর সড়কপথের শেষ স্লাব ইতিমধ্যে বসানো হয়েছে। পদ্মা সেতুর মূল অংশের ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্লাবের সব কটি স্থাপনা সম্পন্ন হওয়ায় ইতিমধ্যে পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে এ সেতু। অক্টোবরের শেষ দিকে কার্পেটিংয়ের কাজ শুরু হবে এবং ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এ প্রকল্পে দেশি-বিদেশি শ্রমিকরা কাজ করছেন বিরতিহীনভাবে।
এর আগে ২০০১ সালে মাওয়া পুরান ফেরিঘাটে মাছবাজার-সংলগ্ন এলাকায় এ সেতুর ফলক উন্মোচন করেন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সরকার বদল হলে থেমে যায় কাজ। ২০০৯ সালে আবার তোড়জোড় শুরু হয় পদ্মা সেতুর কাজের। তখন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়ে এ সেতুর নির্মাণকাজ। একপর্যায়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ায়। তখনই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি দৃঢ়চেতা মনোভাব পোষণ করে সিদ্ধান্ত নেন পদ্মা সেতু করবেনই এবং তা হবে দেশের টাকায়। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু নির্মাণের সার্বিক কাজ শুরু হয়। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর শনিবার বেলা ১টায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সুইচ চেপে মূল কাজের শুভ সূচনা করেন। ফলস্বরূপ স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে ধরা দিয়েছে। অপেক্ষা শুধু সময়ের। যান চলাচলের জন্য আগামী বছরের জুনেই এ সেতু খুলছে বলে আশা করা হচ্ছে।