কোভিড-১৯ ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমনে বিপর্যস্ত সিমান্তবর্তী কুষ্টিয়া জেলা। প্রায় সাড়ে ২২ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই জেলার শহর-গ্রামের অধিকাংশ মানুষই ভাইরাস সংক্রমিত বলে ধারণা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। একই সাথে মৃত্যু পরিসংখ্যানেও একক জেলা হিসেবে শীর্ষস্থানে রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের হিসেব মতে গত দেড় মাসে শুধুমাত্র হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন সনাক্ত রোগীর মৃত্যু সংখ্যা অর্ধ সহ¯্রাধিক এবং হাসপাতাল বাহির্ভুত আছে আরও শতাধিক। এর সাথে য্ক্তু হবে উপসর্গে মারা যাওয়া উল্লেখিত মোট মৃত্যুর আরও অন্তত ৪০%শতাংশ। সরকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও কোভিড সেবায় নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির দেয়া তথ্যে সংক্রমন ও মৃত্যুর সংখ্যা বিষয়ে বেড়িয়ে এসেছে আরও ভয়াবহ চিত্র। মৃত্যু হওয়া রোগীর স্বজনদের অভিন্ন অভিযোগ, অক্সিজেন সংকটই রোগী মৃত্যুর প্রধান কারণ। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি কখনও কখনও অক্সিজেন সংকট হলেও তা সহনীয় পর্যায়ে ছিলো। রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসায় মৃত্যুহার উর্দ্ধমুখী বলে দাবি চিকিৎসকদের।
সরেজমিন অনুসন্ধান কালে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কেউ মরেছেন অক্সিজেন না পেয়ে আবার কেউ মরেছেন অজ্ঞ-অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী, সেচ্ছাসেবী কর্মী এমনকি চিকিৎসকের অবহেলা-অসর্তকায় আক্রান্ত রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসে ত্রæটিপূর্ন মাত্রার অক্সিজেন অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে। অর্থাৎ জেলাটিতে কোভিড নিয়ন্ত্রন ও সেবা কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট মহলের সমন্বয়হীনতা ও একটি দূর্বৃত্তচক্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রনহীন অক্সিজেন নৈরাজ্যই উর্দ্ধগামী মৃত্যু মিছিলের জন্য দায়ী বলে ভুক্তভোগীদের দাবি।
মহামারি করোনা আক্রান্ত যেসব রোগীর দেহে নিন্মগামী অক্সিজেন প্রবাহের মাত্রা মৃত্যুকে তরান্বিত করেছিলো তাদের প্রানরক্ষায় সর্বশেষ সহায়ক উপাদান হিসেবে রোগীদের বাড়তি অক্সিজেনের যোগান দিতে প্রচন্ড চাপের মুখে পড়ে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ ও কোভিড সেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। কোভিড সেবায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোটারী ক্লাব অব কুস্টিয়ার সহ-সভাপতি সৈয়দা হাবিবা বলেন, অক্সিজেন সংকট মোকাবিলায় নানা মহল থেকে সহায়তার উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবে নির্মম সত্য হলো, এজেলাতে মৃত্যুর মিছিলে উর্দ্ধগামীতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে লাগামহীন অক্সিজেন নৈরাজ্যের অভিন্ন অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা বেশ কিছুদিন ধরেই এমন অভিযোগ করে আসছে। বিষয়টি তদন্ত করে উর্দ্ধমুখি এই মৃত্যুর মিছিলের লাগাম ধরতে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের দাবি সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীদের।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন কুষ্টিয়ার নেতা কারশেদ আলম বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোন সুযোগ নেই। জেলায় কোভিড নিয়ন্ত্রনসহ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবায় প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট মহলের সাথে সমন্বিত সামাজিক উদ্যোগ নেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। নচেৎ জেলাতে ক্রমবর্ধমান মৃত্যু মিছিলের লাগাম ধরা অসম্ভব। রোটারিয়ান তুষারের অভিযোগ, আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্য সেবার প্রধান উপকরণ হিসেবে অক্সিজেন নৈরাজ্যের মধ্যে একদিকে আছে মূল্য সন্ত্রাস অন্যদিকে আছে সরাসরি রোগীদের ফুসফুসে প্রয়োগকৃত সঠিক মাত্রা ও পরিমানের অক্সিজেন অনুপ্রবেশ নিয়ে অস্বচ্ছতার প্রশ্ন। আমরা কোভিড রোগীদের সেবা কার্যক্রম করতে গিয়ে নিবির ভাবে লক্ষ্য করেছি কেউ মারা যাচ্ছে অক্সিজেন না পেয়ে আবার কোন কোন রোগী অক্সিজেন পেয়েও এর মাত্রাগত ত্রæটির কারনে রোগী মারা গেছেন। বিষয়টি তদন্ত হওয়া উচিত। কারণ নির্মান শিল্প বা কারিগরি কাজে ব্যবহৃত অক্সিজেন আর মানবদেহে অনুপ্রবেশ যোগ্য অক্সিজেনের পিওরিটি মাত্রা কোন ভাবেই এক নয়। কুষ্টিয়াতে বাড়তি অক্সিজেনের চাপ সামলাতে সিলিন্ডার ভর্তি অক্সিজেনের পরিমান ও মাত্রাগত বিষয়টি নির্নয় চরম ভাবে উপেক্ষিত হয়েছে, যা অজ্ঞতা বশত: সংশ্লিষ্ট সকলের অজান্তেই আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর সংখ্যাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
কুষ্টিয়ায় সিংহভাগ অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মনির অক্সিজেনের স্বত্ত¡াধিকার মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রকৃত অর্থে আমি এই অক্সিজেন রিফিল প্রকল্পটি স্থাপন করেছি নিকটস্থ রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান প্রকল্পে কারিগরি অক্সিজেন সরববাহ করার জন্য। এসময়ে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের বাড়তি অক্সিজেনের চাপ সামলাতে কুষ্টিয়ার কোভিড হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চাহিদা মেটাতেও আমার এখান থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হচ্ছে। তবে এখানকার অক্সিজেন মানবদেহের জন্য উপযুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের। তাছাড়া প্রতিবার সিলিন্ডার রিফিলে মূল্য নির্ধারণেও সরকারী কোন দপ্তরের মনিটরিং করার কিছু নেই। আমরা প্রতিবার আমাদানি চালান মতে সব রকম ব্যয় সংযোজন সহ ধার্যকৃত দরে রিফিল করে দিচ্ছি।
কোভিড ডেডিকেটেড ঘোষিত ২৫০শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক ডা: আব্দুল মোমেন হাসপাতালের অক্সিজেন পরিস্থিতি ও চিকিৎসা সেবায় কিছু সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করেই বলেন, সমস্যা-সীমাদ্ধতা ও অক্সিজেন কেন্দ্রিক স্বার্থন্বেষী মহলের দূর্বৃত্তায়ন কিছু থাকলেও থাকতে পারে। আমাদের দেশের ইতিহাসই এরকম যে মানুষের জীবনের সংকটাপন্ন পরিস্থিতিকে পুজি করে স্বার্থন্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র সব সময়ই থাকে। হাসপাতালে সরবরাহকৃত অক্সিজেনের মাত্রা ও পরিমান নির্নয়ের কোন সুযোগ নেই। বিষয়টি সিভিল সার্জন কুষ্টিয়া ভালো বলতে পারবেন। কুষ্টিয়্সিভিল সার্জন ডা: এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম সিলিন্ডারে সরবরাকৃত অক্সিজেনের মাত্রা ও পরিমানগত বিষয়ে বিভিন্ন জনের করা অভিযোগ পেয়েছেন এমন কথা স্বীকার করে বলেন, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে সিলিন্ডারজাত অক্সিজেনের মাত্রা ও পরিমান নির্নয়ের কোন মাননিয়ন্ত্রনের সুযোগ না থাকায় এবিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই।