সাধারণ মানুষ সাধারণত দুভাবে ব্যাংকে টাকা রাখেন। একটি মেয়াদি আমানত হিসেবে। অন্যটি মাসিক কিস্তিভিত্তিক বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিম। মেয়াদি আমানতের মধ্যে তিন মাস, ছয় মাস, ১০০ দিন ও এক বছর—এ রকম নানা মেয়াদের আমানত সুবিধা রয়েছে। একইভাবে মাসিক কিস্তিভিত্তিক সঞ্চয় স্কিমও বিভিন্ন মেয়াদের রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংক আমানতের ৫২ শতাংশই ৩ মাস ও তার বেশি মেয়াদি। নতুন নির্দেশনার ফলে এসব আমানতকারীর বড় অংশই বাড়তি সুদহারের সুবিধা পাবেন।
তবে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তারা বলছেন, এই নির্দেশনা পুরোনো আমানতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। শুধু নতুন আমানতের ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া সুদ কার্যকর হবে। ব্যাংকে বর্তমানে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, তাই কোনো ব্যাংক নতুন আমানত নিতে খুব বেশি আগ্রহ দেখাবে না। তবে ব্যাংকাররা মনে করছেন, নতুন সিদ্ধান্তের ফলে ধীরে ধীরে ঋণ ও আমানতের সুদ বাড়তে শুরু করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গতকালের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং ব্যাংকিং খাতে দায়-সম্পদের ভারসাম্যহীনতা রোধে ৩ মাস ও তদূর্ধ্ব মেয়াদি আমানতের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানত এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবিষ্য তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড), অবসর-উত্তর পাওনাসহ (পেনশন) বিভিন্ন পাওনা পরিশোধের লক্ষ্যে গঠিত তহবিল বাবদ রক্ষিত যেকোনো পরিমাণ মেয়াদি আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির হার অপেক্ষা কোনোভাবেই কম নির্ধারণ করা যাবে না।
তবে সাধারণ মানুষ মাসিক কিস্তিভিত্তিক যে আমানত ব্যাংকে রাখেন, তাঁদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে দেওয়া এ সুদহার কার্যকর হবে না বলে জানিয়েছেন একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি যদি অনেক বেড়ে যায়, তখন আমরা কী করব। ঋণের সুদ তো সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া আছে। গ্রাহকের আমানতের একটা অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়, যা থেকে কোনো আয় নেই। এমন একটি নির্দেশনা দেওয়ার আগে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। আমরা কয়েকজন এমডি আজ এ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করব। এরপর বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গেও আলোচনা করা হবে। যেহেতু নির্দেশনা তাই বাস্তবায়ন করতেই হবে। তবে নতুন আমানতেই শুধু নতুন সুদহার কার্যকর হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, সম্প্রতি ব্যাংক খাতে আমানতের সুদহার কমছে। অধিকাংশ ব্যাংকের মেয়াদি আমানতে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হারে সুদ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র আমানতকারীসহ অন্যান্য আমানতকারীর একটি অংশ জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যাংকের সুদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মেয়াদি আমানতে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হারে সুদ দেওয়া হচ্ছে বলে আমানতকারীদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে আরও বলা হয়, ‘মেয়াদি আমানতের সুদহার বেশি কমে গেলে জনসাধারণ সঞ্চয়ে নিরুৎসাহিত হন। ফলে অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ খাতসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে।
বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন নির্দেশনা শুধু ৩ মাস ও তার বেশি মেয়াদি এবং স্থায়ী আমানতে কার্যকর হবে। চলতি, সঞ্চয়ী ও কিস্তিভিত্তিক আমানত স্কিমে এই সুবিধা মিলবে না। ব্যাংকগুলোর জুনভিত্তিক সুদ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত জুনে অনেক ব্যাংকই তিন মাস ও তার বেশি মেয়াদি আমানতে ৪ শতাংশের কম সুদ দিয়েছে। এসব ব্যাংককে সুদহার বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা মন্দের ভালো হয়েছে। এখন আমানতকারীরা যে সুদ পান, তাতে কিছুই হচ্ছে না। তবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যথাযথ তদারকি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে ভালো হয় বেঁধে দেওয়া সুদহারের সিদ্ধান্ত তুলে দেওয়া। পাশাপাশি আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) ৩ শতাংশ করে দেওয়া। বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে বাজারই সুদহার নির্ধারণ করে।