করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুরোধে সরকারঘোষিত কঠোর লকডাউনের (৩১ জুলাই) নবমদিন পালিত হচ্ছে। এক সপ্তাহের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও সংক্রমণ ও মৃত্যু হ্রাসের কোনো লক্ষণ নেই। গত কয়েকদিন ধরে দেশে গড়ে দুই শতাধিক করোনা রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
আজ অষ্টম দিনেও সংক্রমণের হার ৩০ দশমিক ৭৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩১ শতাংশ। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আগামী ১ আগস্ট থেকে গার্মেন্টসসহ রফতানিমুখী শিল্প কারখানা খুলে দেয়া হচ্ছে। ফলে আগামীকাল লকডাউনের নবম দিন থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজধানীতে ফিরে আসার ঢল নামবে।
এতে করে শুধু রাজধানীই নয়, বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় করোনার সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়বে। হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়বে। ইতিমধ্যেই রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার বেশ সঙ্কট চলছে। আর রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ঢাকার বাইরের। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে নগরের বাসিন্দারা হাসপাতালে ভর্তির জন্য লাইন দিলে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
করোনার সংক্রমণরোধে গঠিত কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির একাধিক সদস্য এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, গত আটদিন যাবত লকডাউন চললেও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি (শতভাগ মানুষকে মাস্ক পড়তে বাধ্য করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘন ঘন স্যানিটাইজ করা ইত্যাদি) নিশ্চিত ও চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধের কার্যকর বাস্তবায়ন হয়নি। যার ফলে লকডাউনের সুফল পাওয়া যায়নি। সংক্রমণ ও মৃত্যু কমার লক্ষণ নেই। তদুপরি গার্মেন্টসসহ রফতানিমুখী শিল্প-প্রতিষ্ঠান ১ আগস্ট থেকে খুলে দেয়ার ফলে সামনের দিনগুলোতে ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে তাদের আশঙ্কা।
তারা বলছেন, লকডাউনের মূল উদ্দেশ্য ছিল অসংক্রমিত এলাকার জনগণকে সংক্রমিত এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করা, সংক্রমিত এলাকার রোগীদের সংস্পর্শে আসা লোকজনসহ স্থানীয় অধিক সংখ্যক মানুষকে করোনার নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কিন্তু তথাকথিত এ লকডাউনে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগ, এক শহর থেকে আরেক শহর, এক জেলা ও উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায় মানুষ নানাভাবে আসা যাওয়া করেছে। এক্ষেত্রে তথাকথিত লকডাউনে চেকপোস্ট বসিয়ে মানুষের মুভমেন্ট বন্ধ করার নামে কাগজপত্র পরীক্ষা ও জরিমানা করা হলেও সংক্রমণ হ্রাসের মূল কথা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বিশেষ করে শতভাগ মাস্ক পরিধান করার বিষয়টি গুরুত্ব না পাওয়ায় সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির একজন সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘গত প্রায় দেড় বছরেও আমরা সারাদেশের হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা নিশ্চিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারিনি। একদিকে লকডাউন দিয়ে আরেকদিকে মানুষজনকে অবাধে চলাচল করতে দিয়ে করোনার সংক্রমণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যার যা নিয়ে কথা বলার কথা না সে সেটা নিয়ে কথা বলছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তা হাসপাতালে অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করার চাইতে লকডাউন বাড়াতে হবে বলে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছেন। যে বক্তব্য তার দেয়ার কথা না। সাধারণ মানুষের ঘরে খাবার না থাকলে বাইরে বের হবেই। তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য তৃণমূল থেকে শহর পর্যন্ত চেয়ারম্যান, মেম্বার, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইউএনও, ডিসি, এমপি, মন্ত্রীরা রয়েছেন। তারা সঠিকভাবে কাজ করছেন না।’
কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত আট দিনেও লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধের কার্যকর বাস্তবায়ন না হওয়ায় সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে না।’ ফলে সামনে মহাবিপদের আশঙ্কা করে তিনি বলেন, ‘মহাবিপদ থেকে রক্ষা পেতে শতভাগ মানুষকে করোনা স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে, নতুবা ম্যাসাকার হয়ে যাবে।’
ডা. এম ইকবাল আর্সলান আরও বলেন, ‘বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ১ আগস্ট থেকে শিল্পকারখানা খুলে দেয়ায় যারা দেশে গেছে তারা একযোগে ঢাকায় ঢোকার চেষ্টা করবে। শিল্পকারখানার মালিকরা গণমাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কথা বললেও বাস্তবে স্বাস্থ্যবিধি কতটুকু মানার সুব্যবস্থা রাখেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’
কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আরেক সদস্য বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। লকডাউন করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে পারেনি।’
কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে লকডাউন মানে এক এলাকার মানুষ অন্য এলাকায় কোনোভাবেই যেতে পারবে না। কিন্তু লকডাউন চলাকালে নানা অজুহাতে মানুষ বিভিন্ন বিভাগ-জেলা থেকে আরেক বিভাগ ও জেলায় যাতায়াত করেছে। এক্ষেত্রে তারা স্বাস্থ্যবিধিও মানেনি।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে যেন রোগী মারা না যায় সে ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। দেশের শতভাগ মানুষকে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। হতদরিদ্র মানুষ যাদের ঘরে খাবার নেই তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।’ অন্যথায় সামনে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।