পেশায় ঠিকাদার হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা তারা। রয়েছে দলীয় পদও। টেন্ডারবাজিতে দলীয় প্রভাব খাটানোর অভিযোগ পুরনো। তবে এবার তারা দেখালেন পেশিশক্তির প্রকাশ। প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে পাবনায় গণপূর্ত বিভাগের কার্যালয়ে ঢুকে মহড়া দিয়েছেন তারা। ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিষয়টিতে চাঞ্চল্য সৃষ্ট হয়েছে পাবনা শহরে। তথা দলীয় পর্যায়ে এর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও এ বিষয়ে সতর্ক হয়েছে। এরই মধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ গোয়েন্দাদের হস্তগত হয়েছে বলেও খবর রয়েছে। বিষয়টিতে তদন্তও চলছে।
গণপূর্ত বিভাগ সূত্র জানায়, গত ৬ জুনের ওই ঘটনায় নেতৃত্ব দেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক হাজী ফারুক। তার সঙ্গে ছিলেন পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ আর খান মামুন এবং জেলা যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য শেখ লালু। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায় তাদের নেতৃত্বে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জনের একটি দল গণপূর্ত ভবনে ঢুকে পড়েন। এসময় একাধিক ব্যক্তির হাতে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে দেখা যায়। অনেকেই ছিলেন হেলমেট পরা অবস্থায়।
তবে গোলাপী পাঞ্জাবী ও টুপি পরিহিত আওয়ামী লীগ নেতা হাজী ফারুক ছিলেন সবার আগে। এবং ফুটেজে তাকে স্পষ্ট দেখা যায়। তার পেছনে হাফ শার্ট ও মাস্ক পরিহিত অবস্থায় শর্টগান হাতে ছিলেন পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ আর খান মামুন ও সাদা কালো টি শার্ট পরিহিত যুবলীগ নেতা শেখ লালু। সূত্র জানায়, আগতরা বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল আজিমকে খুঁজছিলেন। এক পর্যায়ে তারা উপ সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমানের কক্ষে গিয়ে তার টেবিলে আগ্নেয়াস্ত্র রেখে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তারা বের হয়ে যান।
বিষয়টি এরই মধ্যে ব্যাপক আলোচনায় এলেও প্রভাবশালী ঠিকাদার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চাপে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছিলো। কিন্তু সর্বশেষ গত সপ্তাহে জেলা আইন কমিটির বিষয়ক সভায় বিষয়টি উত্থাপন হলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। পরে গণমাধ্যম কর্মীদের হাতেও এসে পড়ে সিসিটিভি ফুটেজ। এতে দেখা যায়, ৬ জুন দুপুর ১২ টা দুই মিনিট দলটি গণপূর্ত ভবনে ঢুকে পড়ে এবং ১২ টা ১২ মিনিটে তারা অস্ত্র প্রদর্শন করেই বের হয়ে চলে যায়।
পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নিয়ে প্রভাব বলয় তৈরি করে উন্নয়ন কাজের কোটি কোটি টাকার টেন্ডার নিজেদের আয়ত্বে নিতে চেষ্টা করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে থাকা ঠিকাদাররা। তাদের দাপটে অনেক পেশাদার ঠিকাদাররা গণর্পূর্ত বিভাগে টেন্ডার জমা দিতেই পারেন না। এই কাজ নির্বিঘ্ন করতে অফিসের প্রকৌশলী ও কর্মরতদের নিজেদের পক্ষে নিতে তারা নানা ভাবে চাপ প্রয়োগ করেন। সূত্র বলছে, গত ৬ জুনের ঘটনা তারই ধারাবাহিকতায় ঘটেছে বলে তারা মনে করেন।
দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ক্ষমতার দাপট দেখাতে তারা বিভিন্ন সময় শো ডাউন, শক্তি প্রদর্শন অতীতেও করেছেন। তবে, অস্ত্র নিয়ে অফিসে মহড়ার ঘটনাটি নজিরবিহীন। আমরা চরম আতঙ্কে ভুগছি। গণপূর্ত বিভাগ পাবনার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, ঠিকাদারেরা তার কক্ষে গিয়েছিলেন এবং তার টেবিলে অস্ত্র রেখে নির্বাহী প্রকৌশলীর খোঁজ করছিলেন।
বিষয়টি বিল কিংবা টেন্ডার বিষয়ক শোডাউন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পাবনায় নতুন যোগদান করেছি, এসব বিষয়ে আমার জানা নেই।” নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল আজিম জানান, ঘটনার সময় তিনি অফিসের বাইরে ছিলেন। তবে, পরে তিনি নিজেও সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছেন। তাতে অস্ত্র হাতে অনেকে পূর্ত ভবনে ঢুকেছেন তা দেখতে পেয়েছেন।
সরাসরি বা ফোনে কোন হুমকি পাননি, কথাও হয়নি, এমন কথা জানালেন নির্বাহী প্রকৌশলী। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গণপূর্ত বিভাগ থেকে এ বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ করা হয়নি বলে জানান তিনি। অস্ত্র নিয়ে সদলবলে গণপূর্ত বিভাগে ঢোকার কারণ জানতে চাইলে, সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক হাজী ফারুক বলেন, আমি গণপূর্ত বিভাগের ঠিকাদার নই। বিল সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে মামুন ও লালু আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলো। তবে, এভাবে যাওয়া আমাদের উচিত হয়নি।
পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ আর খান মামুন বলেন, নিজের নিরপত্তার স্বার্থে বৈধ লাইসেন্সকৃত অস্ত্রটি নিয়ে আমি ব্যবসায়িক কাজে ইট ভাটায় যাচ্ছিলাম। যাবার পথে নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল আজিমের সাথে কথা বলতে গণপূর্ত বিভাগে যাই। কিন্তু তিনি না থাকায় আমরা ফিরে আসি। তাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়নি।
প্রতিপক্ষ ঠিকাদাররা বিষয়টিকে অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা করছে এমন অভিযোগ তার। তবে যুবলীগ নেতা শেখ লালুর মত, ভুলবশত তারা অস্ত্র নিয়ে অফিসে ঢুকে পড়েছিলেন। পাবনা পুলিশ সুপার মুহিবুল হক খানকে এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। অস্ত্র আইনের শর্ত ভঙ্গ হয়েছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, আমি ঘটনাটি শুনেছি। আইনশৃংখলা বাহিনী বিষয়টি তদন্ত করছে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।