বলিউড। রঙবেরঙের জৌলুসে ঠাসা সে এক চোখধাঁধানো জগৎ। বাইরে থেকে তার আভাস পাওয়া যায় বটে, তবে নাগাল পাওয়া কঠিন। যুগ যুগ ধরে এই বলিউডি ঘরানায় নিজেকে মেলে ধরতে আসে কতশত পতঙ্গ। কেউ পায় নাম, যশ, খ্যাতি। আবার কারও ভাগ্যে স্থায়ী হয় বিস্মৃতি। তারার মতো জ্বলে উঠে আচমকাই খসে পড়ে যায় তাদের সব জৌলুস। সময়ের চাকা ঘুরে গেলে তাদের গল্প লেগে থাকে কেবল পুরনো খবরের কাগজের পাতায় পাতায়।
বলিউডের ঝলমলানো আকাশ থেকে অকালে খসে পড়া তেমন কিছু তারার গল্পই রইল আজকের এই প্রতিবেদনে।
মীনা কুমারী
ভারতের মুম্বাইতেই জন্ম তার। বলিউডের রঙিন জগতে টানা ৩৩ বছর ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন মীনা কুমারী। ‘সাহেব বিবি অর গুলাম’ থেকে ‘পাকিজা’, তার অভিনয়ে উজ্জ্বল চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকের একাধিক সাদা-কালো ছবি। তার রূপের ছটা আজও মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে ফিল্ম ক্রিটিকদের। কিন্তু এই মীনা কুমারীর জীবনদীপ খুব তাড়াতাড়ি নিভে গিয়েছিল।
১৯৭২ সালে মুম্বাইয়ের হাসপাতালে যখন তিনি কোমায়, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তখন তার বয়স মাত্র ৩৮ বছর। ‘পাকিজা’ ছবির মুক্তির কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মীনা। দিন-দুয়েকের যমে-মানুষে টানাটানির পর অবশেষে ইহলোকের জাল থেকে মুক্তি পান বলি-দুনিয়ার ‘ট্র্যাজেডি কুইন’। চিকিৎসকরা জানান, লিভার সিরোসিসে মৃত্যু হয়েছে তার। অতিরিক্ত মদ্যপান থেকেই এই রোগ তিনি বাধিয়েছিলেন, মনে করেন কেউ কেউ।
মধুবালা
‘মুঘলে আজম’-এর আনারকলি তিনি। ২২ বছরের কেরিয়ারে বলিউডকে অন্তত ৭০টি ঝকঝকে ঝলমলে ছবি উপহার দিয়েছিলেন মধুবালা। দিল্লির এই অভিনেত্রীও রূপে গুণে মুগ্ধ করতে পেরেছিলেন সে যুগের দর্শক আর হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কলাকুশলীদের। কিশোর কুমারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেধেছিলেন মধুবালা। দিলীপ কুমারের সঙ্গে তার সম্পর্কের গুঞ্জনও কম রসালো নয়।
এই মধুবালা মারা যান আরও কম বয়সে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই সাঙ্গ হয় তার ইহলীলা। ১৯৬৯ সালের শুরুতে জন্ডিস হয়েছিল মধুবালার। সেই ধাক্কা আর সারেনি। বেশ কিছুদিন অসুস্থতার পর ফেব্রুয়ারি মাসের ২২ তারিখ হার্ট অ্যাটাক হয় মধুবালার। বলিউডকে কাঁদিয়ে অকালে চলে যান আনারকলি।
স্মিতা পাতিল
বলিউডে সত্তর-আশির দশকে অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন স্মিতা পাতিল। পর্দায় তার অভিনয় দক্ষতা তাকে এনে দিয়েছিল পদ্মশ্রীসহ একাধিক পুরস্কার, সম্মান। শুধু তো হিন্দি নয়, বাংলা, কন্নড়, মারাঠি, তামিল একাধিক ভাষার ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় দেখা গেছে তাকে। সব ক্ষেত্রেই ছিলেন সমান সাবলীল। তবে বলিউডের গ্ল্যামার দুনিয়ায় জ্বলে উঠেও অচিরেই নিভে গেছেন স্মিতা।
১৯৮৬ সালে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে চাইল্ড বার্থ কমপ্লিকেশনে তার মৃত্যু হয়। ছেলে হয়েছিল স্মিতার। রাজ বাব্বর আর স্মিতা পাতিলের সেই ছেলে প্রতীক বাব্বর এখন বলিউডের চেনা মুখ। মৃত্যুকালে স্মিতা পাতিলের বয়স হয়েছিল মাত্র ৩১ বছর। ছেলেকে জন্ম দেওয়ার পর মাত্র সপ্তাহ দুয়েক বেঁচে ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর অনেক পরে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ উঠেছিল। সে অভিযোগ নাকি তুলেছিলেন খোদ বাংলা চলচ্চিত্র জগতের দিকপাল পরিচালক মৃণাল সেন।
সিল্ক স্মিতা
আশি-নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণি চলচ্চিত্র জগতে যৌনতায় ঝড় তুলেছিলেন সিল্ক স্মিতা। বলিউডের যৌন রগরগে অভিনেত্রীদের মধ্যে অন্যতম তিনি। মূলত নৃত্যশিল্পী হিসেবেই বড় পর্দায় সিল্কের আত্মপ্রকাশ হয়েছিল। দারিদ্র্যের হাত থেকে রেহাই পেতে যৌনতাকে হাতিয়ার করেছিলেন তিনি। তার শরীরী বিভঙ্গে জুড়িয়েছিল বহু পুরুষের কামনার জ্বালা।
কিন্তু মাত্র ৩৫ বছরেই জীবন শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন সিল্ক। অবসাদগ্রস্ত হয়ে দিনের পর দিন মনের জ্বালা জুড়োতেন নেশায় ডুবে থেকে। অত্যধিক মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় নিজের বাড়িতেই। ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলে, তার শরীরে প্রচুর অ্যালকোহল পাওয়া গিয়েছিল।
দিব্যা ভারতী
চলচ্চিত্র জগতে মাত্র তিন বছরের আয়ু নিয়ে এসেছিলেন দিব্যা ভারতী। সর্বসাকুল্যে জীবনের আয়ু ছিল ১৯ বছর। আর এইটুকু সময়ের মধ্যেই আরব সাগরের পাড়ে যেন হিল্লোল তুলে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯০ সালে একটি তেলেগু ছবির মাধ্যমে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন বড় পর্দায়। তার আগে অবশ্য মডেলিংও করেছেন। নব্বইয়ের দশকের এই শুরুর সময়টাতেই বলিউড জয় করে ফেলেছিলেন দিব্যা। সে সময়ের সর্বোচ্চ রোজগেরে নায়িকাদের তালিকায় তিনিও ছিলেন অন্যতম।
রূপের মাধুরীই দিব্যাকে শীর্ষে তুলেছিল। আর হয়তো সেই রূপই কাল হয়েছিল তার জীবনেও। বলিউডে দিব্যা ভারতীর মৃত্যু ঘিরে আজও জট পাকিয়ে আছে রহস্য। ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন দিব্যা। আর ১৯৯৩ সালের ৫ এপ্রিল রাতে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে পাঁচতলার বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় তার। নিছক দুর্ঘটনা, না এই মৃত্যুর পেছনে বড় কোনো ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে, বলিউড আজও তার উত্তর খুঁজে চলেছে।
শোনা যায়, সেদিন রাতে দিব্যার বাড়িতে বেশ কিছু অতিথি এসেছিলেন। সকলের চোখ এড়িয়ে এত বড় দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটে গেল, সেই প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলেন, রূপের জোড়ে এত কম সময়ে বলিউডের মাথায় উঠে পড়েছিলেন দিব্যা, আর তার এই সাফল্য সহ্য করতে পারেননি কাছের লোকজনরাও। মৃত্যুরহস্য অমীমাংসিত, তাই দিব্যা ভারতীকে ঘিরে ডালপালা মেলেছে এমনই নানা গুজব।
গীতা বালি
পঞ্চাশের দশকে বলিউডে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন গীতা বালি। তার ঝুলিতে রয়েছে ‘বড়ি বেহেন’, ‘নিশানা’, ‘বাজি’, ‘সোহাগ রাত’, ‘কফি হাউস’ আর ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’র মতো ছবি। শাম্মি কাপুরকে বিয়ে করে কাপুর পরিবারের সদস্য হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গীতা বালির জীবনও ছিল একেবারে ক্ষণস্থায়ী। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল তার।
জিয়া খান
২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটি হিন্দি ছবিতে দেখা গেছে জিয়া খানকে। বলিউডে অভিনয়ের জন্য তিনি যত না জনপ্রিয় ছিলেন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি জনপ্রিয়তা পান তিনি মারা যাওয়ার পর। কারণ তার মৃত্যুও রহস্যের ঘেরাটোপে বাঁধা। ২০১৩ সালের ৩ জুন মুম্বইয়ে নিজের বাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় জিয়া খানের দেহ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৫। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয় তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
কিন্তু সময় যতই এগোতে থাকে ততই দানা বাঁধতে থাকে রহস্য। মৃত্যুর কিছুদিন পর তার বাড়ি থেকে হাতে লেখা একটি চিঠি পাওয়া যায়। জিয়ার প্রেমিক সুরজের নাম জড়ায় এই মৃত্যু রহস্যে। তাকে কিছুদিন হাজতবাসও করতে হয়। পরে জিয়া খানের মৃত্যু রহস্যের তদন্তভার নেয় সিবিআই। মুম্বই হাইকোর্ট এমনকি সুপ্রিম কোর্টেও মামলা গড়ায়। শেষ পর্যন্ত সিবিআই এই মামলায় খুনের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। বলা হয়, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যাই করেছেন জিয়া।
ভিমি
সত্তরের দশকে বলিউডের চেনা মুখ ছিলেন ভিমি। বেশ কিছু ছবিতে তার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু একটা সময় তার একের পর এক ছবি মুখ থুবড় পড়তে থাকে বক্সঅফিসে। ফলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এই পাঞ্জাবী অভিনেত্রী। কলকাতায় একটি ছোটখাটো ব্যবসাও শুরু করেছিলেন, তবে দাঁড় করাতে পারেননি তাও। নেশার মাঝেই ভিমি খুঁজতে চেয়েছিলেন মুক্তি। সেই নেশাই তাকে মুক্তি দিয়েছে। ১৯৭৭ সালে ৩৪ বছর বয়সে লিভারের জটিল রোগে মৃত্যু হয় তার। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলেই এই পরিণতি, জানান চিকিৎসকরা।
পরভিন বাবি
সত্তরের দশকে বলিউডের ফ্যাশন আইকন ছিলেন পরভিন বাবি। গ্ল্যামার দুনিয়ায় তার দাপট ছিল দেখার মতো। ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ‘কালা পাথর’, ‘নমক হালাল’-এর মতো ছবিতে অভিনয়ে মাত করেছিলেন বাবি। বিয়ে না করলেও হিন্দি ফিল্ম দুনিয়ায় একাধিক তারকার সঙ্গে পরভিন বাবির সম্পর্কের গুঞ্জন শোনা যায়।
শেষ জীবনে তুমুল ডিপ্রেশনে ভুগেছেন তিনি। অবসাদই তার প্রাণ কেড়েছে অকালে। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মাল্টিপল অর্গ্যান ফেলিওরে মৃত্যু হয় বাবির।