সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উপাচার্যের পদত্যাগসহ নানা দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিতের ৮ মাস পেরিয়ে গেলে পূরণ হয়নি শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ দাবি। এখনো স্বপদে বহাল আছেন উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। প্রত্যাহার হয়নি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলাও। উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন না পুলিশের শটগানের গুলিতে আহত সজল কুন্ডু। তার আয়ের একমাত্র অবলম্বন ক্যান্টিনটিও ফিরিয়ে নিয়েছে প্রশাসন।
আন্দোলনকারীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে দাবি শিক্ষার্থীদের। এখানেই শেষ নয়; শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি ৮ মাসেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। তথ্য-প্রমাণ চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ আর একটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ে সীমাবদ্ধ রয়েছে তদন্ত কমিটির কার্যক্রম। এসব ঘটনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ছাত্রীরা।
১৬ জানুয়ারি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করা অবস্থায় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং তাদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পরে এই আন্দোলন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়।
পরে ১৭ জানুয়ারি থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করতে থাকে শিক্ষার্থীরা। ১৯ জানুয়ারি থেকে একই স্থানে অনশন শুরু করেন ২৮ শিক্ষার্থী। ২৬ জানুয়ারি সরকারের অনুরোধে শাবির সাবেক শিক্ষক ড. জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমিন হক ২৮ শিক্ষার্থীর ১৬৩ ঘণ্টার অনশন ভাঙান। উপাচার্যের পদত্যাগের ব্যাপারে তখন শাবির সাবেক এই দুই শিক্ষকের মাধ্যমে ‘সরকারের উচ্চপর্যায়’থেকে শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তবে অনশন ভাঙলেও আন্দোলন চালিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। শেষমেশ ১২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন প্রত্যাহার করেন তারা।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের কাছে পাঠানোর আশ্বাস দেন। শিক্ষার্থীদের অন্যান্য দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারেও আশ্বস্ত করেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, আন্দোলন প্রত্যাহারের আট মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও আমাদের দাবিগুলোর অধিকাংশই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের প্রথম এবং প্রধান দাবি ছিল- ‘দ্রুততম সময়ে ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে উপাচার্য পদ থেকে অপসারণ করে একজন গবেষণামনা, শিক্ষাবিদ ও অবিতর্কিত ব্যক্তিকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক’।
শিক্ষামন্ত্রী এই বিষয়ে বলেছিলেন, ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ আচার্যের কাছে উপস্থাপন করা হবে। আচার্য এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এছাড়াও সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাসমূহ তোলা হয়নি। ১৬ জানুয়ারির হামলার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সজল কুন্ডুকে অন্তত ৯ম গ্রেডের একটি চাকরি এবং নগদ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার স্পষ্ট আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সজল এখনো শিক্ষামন্ত্রী কর্তৃক প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ বা চাকরি কোনোটাই পাননি। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তিনি যে ক্যাফেটেরিয়াটি চালাতেন সেটিও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তার একমাত্র কর্মসংস্থান কেড়ে নেওয়ায় এমনিতেই স্প্লিন্টার ও বোমার মারাত্মক ক্ষত নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতেও হিমশিম খাওয়া সজলের সামনে নতুন আতঙ্ক হয়ে এসেছে চরম অর্থ সংকট।
চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথম কিছুদিন সরকারি তত্ত্বাবধানে সজলের নিয়মিত চেকআপের ব্যবস্থা করা হলেও গত তিনমাস ধরে তাও বন্ধ। বারবার এ ব্যাপারে অবহিত করার পরও সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কারও তরফ থেকেই আর সজলের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া হচ্ছে না।
সজল কুন্ডু বলেন, ‘আমার ডান হাতে এখনো ৩০টি ধাতব টুকরা আছে। এই হাতে ভারি কাজ করতে পারি না। দুটি ধাতব টুকরা আমার ফুসফুসের কাছে, সে কারণে মাঝে মধ্যে শ্বাসকষ্টও হয়েছে। শারীরিক এসব সমস্যার মধ্যেও আমার কোনো খোঁজ তো নেয়নি, বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমার একমাত্র আর্থিক অবলম্বনও কেড়ে নিয়েছে।’
সজল বলেন, ‘মাসখানেক আগে জাফর স্যার ফোন করেছিলেন। স্যার বলেছিলেন, কেউ আমার চিকিৎসার ভার না নিলেও তিনি নেবেন। স্যারের সেক্রেটারি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ছিল। কিন্তু গত একমাসেও স্যার-ম্যাডাম কেউই যোগাযোগ করেননি।’
এ প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা গঠিত তদন্ত কিমিটির সদস্য ও তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তুলশি কুমার দাস বলেন, পদাধিকার বলে তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলাম। সভাপতি থাকাকালীন একটি মিটিংয়ের চিঠি পেয়েছিলাম, ওইটায় জয়েন করেছি। এরপর আর কখনো আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। আমিও কিছু জানি না। ধরে নিয়েছি সভাপতিত্ব শেষ হওয়ায় মনে হয়, আমি আর ওই কমিটির সদস্য না। বর্তমান সভাপতি এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন।
শাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো আখতারুল ইসলাম বলেন, এরকম কোনো কমিটির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদার বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তদন্তে কী পাওয়া গেছে তা প্রতিবেদনে আমরা তুলে ধরব।
আন্দোলনকারীদের অন্যতম মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজ অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক ইয়াসমীন হকের বরাত দিয়ে জানান, ‘সরকারের উচ্চপর্যায়’ আশ্বাস দেওয়ার এতদিন পরেও কথা না রাখায় বিব্রত ও ক্ষুব্ধ স্যার-ম্যামও। আমাদের বেশি যোগাযোগ হয় অধ্যাপক ইয়াসমীন হক ম্যামের মাধ্যমে। সর্বশেষ মাসখানেক আগেও স্যার-ম্যাম বলেছিলেন। তাদের নিয়মিত সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণের কাজ চলছে। তবে এতদিনেও দাবি পূরণ না হওয়া নিয়ে তারাও উদ্বিগ্ন। জাফর স্যার বিষয়টি নিয়ে বারবার সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করছেন। তারা সব দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করছেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি সূত্র জানিয়েছে, শাবি উপাচার্যকে সরানোর বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে পাঠানো ফাইলটি ফেরত এসেছে।
ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের বিষয়, সে ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না। শিক্ষার্থীদের অনেক দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আন্দোলন শুরু হয়েছিল হল সংক্রান্ত বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে, সেগুলো সমাধান হয়েছে। মামলার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ভালো পারবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। কে মামলা করল না করল ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ জানে।
সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নাজমুল হুদা খান জানান, এখনো মামলার তদন্ত চলছে।