প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ গত এক মাসের ব্যবধানে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও শনাক্তের নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। গত ৫ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত কারা বেশি আক্রান্ত হয়েছে এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান এখন দুটি—বাজার এবং গণপরিবহন। দেশে এখন পর্যন্ত যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বড় অংশই হয় বাজারে গেছেন, নয়তো গণপরিবহন ব্যবহার করেছেন।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, যেসব জায়গা থেকে মানুষ বেশি সংক্রমিত হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে উপাসনালয়, সভা-সেমিনারের মতো জনসমাগমস্থল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে ভ্রমণ, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া এবং পর্যটনকেন্দ্র। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের হিস্ট্রি (ইতিহাস) পর্যালোচনা করে সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ এসব উৎসস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে।
ওই সাড়ে আট হাজার রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে গিয়েছিলেন ২৬ শতাংশ, করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসেছিলেন ২২ শতাংশ। এ ছাড়া আন্তঃবিভাগ ভ্রমণ করেছিলেন ১৩ শতাংশ, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন ১২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইইডিসিআর আক্রান্ত রোগীদের ‘কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং’ (রোগীর সংস্পর্শে আসা সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করা) এর কাজটি করে আসছে। এই সময় রোগীদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেগুলোর মধ্যে আছে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তি সংক্রমিত হওয়ার আগে কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন এবং কোথা থেকে সংক্রমিত হয়েছেন বলে ধারণা করেন। রোগীদের কাছ থেকে সংগৃহীত সব তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও সরবরাহ করা হয়।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন বলেন, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে। তবে এর আদর্শ ব্যবস্থাটা হতো সবাইকে ঘরে রাখতে পারলেই। কিন্তু জীবন জীবিকার তাগিদে মানুষ বাইরে বের হচ্ছে। এ অবস্থায় সংক্রমণ কমাতে হলে তাদের সমস্যাগুলোও তো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো সংক্রমণ যেন না বাড়ে, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু সংক্রমণ যেভাবে দাবনলের মতো বাড়ছে, সেক্ষেত্রে আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপই ঝুঁকি বিবেচনায় সুনির্দিষ্ট করে নিতে হবে।
মোশতাক হোসেন বলেন, অধিকাংশ মানুষ প্রয়োজনেই ঘর থেকে বের হচ্ছে, প্রয়োজন ছাড়া খুব মানুষই বের হচ্ছে। এখন যারা জীবিকার তাগিদে বের হতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের তো জোর করে আবদ্ধ করে রাখা যাবে না। আর বের হওয়ার পর তাদের জন্য যদি গণপরিবহনের ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে তো তারা গাদাগাদি করেই যে যেভাবে পারে গন্তব্যে ছুটবে। এতে বরং তাদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। তারচেয়ে সীমিত আকারে কিছু গণপরিবহন চালু করে দিয়ে স্বাস্থ্যবিধিটা যদি মানতে বাধ্য করা যায়, তাহলেই হয়তো ভালো হবে।
কোভিড বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সরকার দ্বিতীয় দফায় লকডাউন ঘোষণা করেছে। কিন্তু লকডাউন মানে কী, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। এই যে আবারও এক সপ্তাহের লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে, সেটা কী? এটা তো সরকারকে সুস্পষ্ট করতে হবে। একবার লকডাউন দিয়ে গণপরিবহন, দোকানপাট বন্ধ করলেন, আবার খুলে দিলেন। এখন কী ধরনের লকডাউন করতে চাচ্ছেন সেটা তো বুঝাতে হবে। বলা হচ্ছে সর্বাত্মক লকডাউন, এটার তো ডেফিনিশন (সংজ্ঞা) লাগবে। কবিতার ভাষা দিয়ে তো টেকনিক্যাল কাজ চলে না। এরকম চলতে থাকলে অনেক মানুষ মারা যাবে।
তিনি বলেন, আমরা কারফিউ বলতে বুঝি রাস্তায় বের হওয়া যাবে না। লকডাউনে কী মানুষ বের হতে পারবে না? অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে? নাকি সবকিছুই খোলা থাকবে শুধু আগের মতো গণপরিবহন আর দোকানপাট বন্ধ থাকবে? যদি তাই হয়, মানুষ কি হেঁটে হেঁটে অফিসে যাবে? এভাবে তো লকডাউন হয় না, আর হলেও কোনো কার্যকরী ফলাফল আসবে না।
নজরুল ইসলাম বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো শুধু স্বাস্থ্যবিধি যদি মেনে চলেন, তাহলেই হবে। স্বাস্থ্যবিধি বলতে প্রথমত হলো মাস্ক পরা, দ্বিতীয়ত ব্যক্তিগত দূরত্ব, তারপর হলো হাত ধোয়া। এই তিনটি জিনিস যদি প্রত্যেকেই পালন করে, তাহলে আর কিছুই করতে হবে না।
তিনি আরও বলেন, মাস্ক ছাড়া একজনও থাকবে না। দোকানদারও থাকবে না, ক্রেতাও থাকবে না এবং দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। একটা দোকানে যদি ১০ ফিট জায়গা থাকে, তাহলে দুইজনের বেশি ক্রেতা ভেতরে ঢুকবে না, বাকিরা বাইরে দূরত্ব মেনে সিরিয়াল মেইনটেইন করবে। যদি এভাবে মানানো যায়, তাহলে আর লকডাউন লাগবে না।