স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিক্ষার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে, সারাদেশে শতভাগ শিক্ষার্থীর স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। স্কুল-কলেজ, মাদরাসা-কারিগরি ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। বিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় করে পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি ও কারিকুলামে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। চলতি বছর পাইলটিং শুরু হয়েছে। আগামী বছর থেকে প্রথম শ্রেণি, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এটি কার্যকর করা হবে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) থেকে জানা গেছে, ১৯৭২ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ৭ হাজার ৭৯১টি। এগুলোয় শিক্ষার্থী ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ। এখন দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ২০ হাজার ৮৪৯টি। শিক্ষার্থী রয়েছে এক কোটিরও বেশি। ১৯৭২ সালে দেশে কলেজ ছিল ৫২৬টি। আর এখন আছে ৪ হাজার ৬৯৯টি। এখন কলেজ পর্যায়ে পড়াশোনা করছে প্রায় ৪৬ লাখ শিক্ষার্থী। সারাদেশে আলিয়া ও দাখিল মাদরাসা আছে ৯ হাজার ৩০৫টি। এসব মাদরাসায় শিক্ষার্থী সাড়ে ২৫ লাখের বেশি।
এদিকে, বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শতভাগের কাছাকাছি শিক্ষার্থী এখন বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশে। ২০০৫ সালেও প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৭ শতাংশের মতো। মাধ্যমিকেও ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন-এনজিও পরিচালিত মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে এক লাখ ৩৩ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজারের বেশি। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ২৬ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের পর আর কোনো সরকার একসঙ্গে এতো প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেনি।
দেশে এখন প্রাথমিক স্তরে দুই কোটির বেশি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। এর মধ্যে ৫১ শতাংশই ছাত্রী। সরকারি বিদ্যালয়ে এই হার আরও বেশি। ভর্তির দিক দিয়ে মাধ্যমিকের ছাত্রীদের হার আরও বেশি (প্রায় ৫৫ শতাংশ)। সংখ্যা বিচারে কলেজেও ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে সমতা অর্জিত হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ছাত্রীরা সংখ্যায় পিছিয়ে। যদিও মেডিকেল শিক্ষায় ছাত্রীরা এগিয়ে আছেন।
তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র ছয়টি। আর এখন সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে দেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয় ১৫৮টি। তবে এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বেশির ভাগের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউসিজি) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। সেখানে গবেষণা কার্যক্রম নেই। ২০২০ সালে দেশের ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৭টি গবেষণা খাতে কোনো অর্থই ব্যয় করেনি। ট্রাস্ট্রি বোর্ডে দ্বন্দ্ব, আর্থিক অনিয়ম, অবকাঠামো সংকট, স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরে অনীহাসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান অর্জনে এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি দেশ।
জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক একরামুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, সাক্ষরতার হার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়েনি। এ জন্য সরকারিভাবে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভর্তির হার, পাসের হার, ঝরে পড়া রোধ, ছাত্র-ছাত্রীর সমতা, উপবৃত্তি, বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে সংখ্যাগত দিক দিয়ে শিক্ষার অর্জন ও উন্নতি দৃশ্যমান। তবে শিক্ষার মান সেভাবে বাড়েনি।
এদিকে, করোনার ধাক্কায় প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারিভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, স্বাধীনতার পর দেশে শিক্ষায় সংখ্যার দিক দিয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। এখন এই অগ্রগতি ধরে রেখে শিক্ষার মানের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারও বিষয়টি অনুধাবন করে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নসহ নানা রকম চেষ্টা করছে। তবে তার সুফল বয়ে আসছে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মাথায় রেখে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজাতে হবে।
তিনি বলেন, করোনার পর দেশের জাতীয় বাজেটে আমরা শিক্ষা খাতের বরাদ্দ দেখে হতাশ হয়েছি। বাজেটে অর্থের পরিমাণ বাড়ানো হলেও মোট বরাদ্দ আরও কমে গেছে। শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করা জরুরি। মোট বরাদ্দও সঠিকভাবে ব্যয় হয় না। প্রতিবছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় না হওয়ায় ফেরত দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষায় এখন মেগা প্রকল্প নেওয়ার সময় হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, যেসব উপজেলায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ নেই, সেগুলোয় একটি করে বিদ্যালয় ও কলেজ সরকারি করা হয়েছে। আগে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম হতো। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ হওয়ায় সেই অভিযোগ কমেছে। এছাড়াও শিক্ষাথীদের জন্য অনলাইনে ভর্তিপ্রক্রিয়া চালু, লটারির মাধ্যমে ভর্তি করা হচ্ছে।
তবে, ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলেও এক যুগ পরেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। বরং শিক্ষানীতি উপেক্ষা করে জাতীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগপর্যন্ত কোনো পাবলিক পরীক্ষা না রাখার কথা বলা হয়েছে। অথচ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উল্টো প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড করে এই (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী) পরীক্ষাকে স্থায়ী করতে চাচ্ছে। এমনকি এক দশক আগে শিক্ষা আইনের খসড়া করা হলেও এখনো তা অনুমোদন হয়নি।