উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। পছন্দের দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা। শিক্ষাছুটিকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন-ভাতা সবই দেয়। শর্ত থাকে নির্ধারিত শিক্ষাছুটি শেষে তাদের আবার দেশে ফিরতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন সময় দেখা গেছে এর উল্টো চিত্র। এসব শিক্ষকের অনেকে দেশের টাকায় বিদেশের মাটিতে বিলাসী জীবন গড়ছেন। আবার কেউ হয়েছেন উধাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বারবার শোকজ দেওয়া হলে উত্তর পর্যন্ত দেন না তারা।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বর্তমানে দেশের ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ৬৮০ জন শিক্ষক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ছুটি শেষ হলেও দেশে ফেরেননি ২৭১ জন। দীর্ঘদিন দেশে না ফেরায় এর মধ্যে ১২০ জন চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
আইন অনুযায়ী, বিদেশে যাওয়া শিক্ষকরা বৈতনিক, অবৈতনিকসহ বিভিন্নভাবে সর্বোচ্চ চার বছর পর্যন্ত ছুটি নিতে পারেন। এসময় কারও ডিগ্রি বা গবেষণা শেষ না হলে আরও দুই বছরের অবৈতনিক ছুটি দেওয়া হয়। তবে তার জন্য নিয়ম হলো- চার বছর ছুটি ভোগের পর দেশে ফিরে কাজে যোগদান করতে হবে। এরপর আবেদন করতে হবে দুই বছরের জন্য ছুটির। এছাড়া চার বা ছয় বছর ছুটি ভোগের পর কেউ যদি পদত্যাগ করতে চান, তাহলে তাকে ছুটির সময় নেওয়া অর্থ ফেরত দিতে হয়। অথবা সমপরিমাণ সময় চাকরি করার পর নিতে হয় অব্যাহতি। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ছুটিতে থাকাকালীন দেশের বাইরে থেকে উপার্জন করেন।
কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন শিক্ষক বিদেশে
ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্কলারশিপ, পিএইচডি বা প্রেষণ, অবকাশ যাপন, চিকিৎসা ও অন্যান্য কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫৬ জন শিক্ষক বিদেশে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ২৯ জন শিক্ষক নির্ধারিত সময় পার হলেও আর কর্মস্থলে ফেরেননি। ফলে নিয়ম অনুযায়ী তাদের কাছে পাওনা টাকা আদায় শুরু হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ৩৭ জনকে। তাদের কাছ থেকেও পাওনা টাকা আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ১৭১ জন শিক্ষক বিদেশে আছেন। তাদের মধ্যে ৪১ জনের ছুটি শেষ হলেও ফিরছেন না দেশে। ফলে এ পর্যন্ত ২১ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বাকিদের বিষয়ে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে।
এছাড়া উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশ গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেননি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ছয়জন শিক্ষক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৭ জন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৪, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) ৭৪, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩, বাংলাদেশ টেক্সটাইলের ২৫, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৯, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তির ৭৩, চট্টগ্রাম প্রকৌশলী ও প্রযুক্তির ১০০, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ৩৫, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ৫৪ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির আটজনসহ মোট এক হাজার ৬৮২ জন শিক্ষক বিদেশে অবস্থান করছেন।
বুয়েটের রেজিস্ট্রার ফোরকান আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, কোনো শিক্ষক উচ্চশিক্ষা বা অন্য কারণে ছুটিতে বিদেশে গেলে নির্ধারিত সময়ে না ফিরলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র তৈরি করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী তাকে করা হয় শোকজ। তার উত্তর সন্তোষজনক না হলে সেই ফাইল সিন্ডিকেট সভায় তোলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যরা তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, উচ্চশিক্ষার জন্য ৫০ শতাংশ শিক্ষকের বিভিন্ন শর্তে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যাওয়ার নিয়ম আছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দুই বছরের জন্য ছুটি নিয়ে গেলেও ছুটি শেষের তিন মাস আগে নানা অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও ছয় মাস বা এক বছর ছুটি বাড়িয়ে নেন। যাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আনুকূল্য আছে তারা বাড়তি ছুটি দ্রুত পেয়ে যান। এভাবে ধাপে ধাপে ছুটি বাড়ালেও পরে আর ফিরে আসেন না। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশে সেই শিক্ষক কাজ করে টাকা উপার্জন করছেন।
তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি সুবিধা নিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। তবে কোর্স অনুযায়ী প্রথম ধাপে দুই বা তিন বছর যে ছুটি নেবে সেটি শেষ হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। এরপর থাকলে তাকে বিনা বেতনে গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে ছয় মাস, এক বছর বা দুই বছর পর্যন্ত বেতন ছাড়া ছুটি দেওয়া যেতে পারে। যারা পাঁচ-ছয় বছর বা তার বেশি সময় ধরে বিদেশে আছেন তাদের পেছনে না ঘুরে চাকরিচ্যুত করা প্রয়োজন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করারও প্রয়োজন নেই।
ইউজিসি থেকে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, বিদেশে গিয়ে শিক্ষকদের একটি অংশের না ফেরাটা নতুন কিছু নয়, এটি দীর্ঘদিনের প্রবণতা। যারা নিয়মমাফিক বিদেশে উচ্চ ডিগ্রির জন্য গিয়ে নির্ধারিত সময়েও ফিরছেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের রয়েছে। যারা ফিরছেন না তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা ও নোটিশ দেওয়া হয়। তার জবাব যদি কেউ না দেন তবে যথাযথ প্রক্রিয়ার গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুসরণ করার কথা থাকলেও সেটি কেন তারা করছে না তা দেখা দরকার।
শিক্ষকদের এ ধরনের অনিয়ম বন্ধে কয়েকটি পরামর্শ দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এটি পরিহার করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালাগুলোয় শিক্ষকদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। কী প্রক্রিয়ায় তাদের অপসারণ করা হবে সেটি পরিষ্কার করা দরকার। কেউ না ফিরলে তা নিয়মের লঙ্ঘন। অবৈধভাবে বেতন-ভাতা নেওয়া অপরাধ, এর বিচার হতে হবে। এজন্য যদি নির্দিষ্টভাবে শাস্তি উল্লেখ করা যায় তবে তা প্রতিরোধ করা যাবে। এমন জালিয়াতি করছেন তারা সমাজের সম্মানিত শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। তাদের পক্ষে এমন কাজ করাটা গ্রহণযোগ্য নয়। এটি বিব্রতকর ও শিক্ষক হিসেবে কলঙ্কের অংশ।
জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, অনেক শিক্ষক নির্ধারিত সময় পার হলেও কর্মস্থলে না ফিরে যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ করে দেন, এটি সত্যিই দুঃখজনক।
তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিক্ষকদের বন্ড থাকে। যেসব শিক্ষক ফিরে আসতে অনীহা প্রকাশ করবেন, তাদের বিরুদ্ধে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী যেসব ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, কর্তৃপক্ষ তাও নেবে।
ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, শিক্ষকতার আদর্শ ও নীতির স্থান থেকে সরে আসায় একজন ব্যক্তির পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব। এতে একদিকে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হচ্ছে শিক্ষক সংকট। যে কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য রাজস্ব খাতে বৃত্তি কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে ইউজিসি। সেখান থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে তিন বছরের ব্যয় বহন করা হবে। বিশ্বের র্যাংকিংয়ে ৩০০তম অবস্থানে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আবেদন করা যাবে। এর শর্ত হিসেবে শিক্ষককে দিয়ে যেতে হবে চাকরির অব্যাহতিপত্র। চার বছরের মধ্যে তিনি ফিরে না এলে এটি কার্যকর করতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ বাবদ যত অর্থ ব্যয় হবে তা ফেরত দিতে হবে শিক্ষককে। নতুবা তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।