অধিকার অক্টোবর মাসের হিসাব প্রকাশ না করলেও আরেকটি মানবাধিকার সংঠন আইন ও সালিস কেন্দ্র জানিয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গত মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিন জন। দুই মানবাধিকার সংগঠনের হিসাবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর—এ দু’মাসে নিহত হয়েছেন ১১ জন।
অধিকারের হিসাবে আগস্টে দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ওই মাসে গণপিটুনিতে ১৪ জন এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৩৪জন। দুই মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩১ জন। আর রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৫২ জন।
বৃহস্পতিবার অধিকার এই প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরো তথ্য প্রকাশ করেছে। তবে পুলিশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না বলে দাবি করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর।
আগস্টের আগের ঘটনাগুলো
ত্রৈমাসিক এই মানবাধিকার প্রতিবেদনে ২০২৪ সালকে তিনটি ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কাল, ৬ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সরকারবিহীন সময়কাল এবং ৯ আগস্ট থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধরা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। এ সময় এক হাজার ৫৮১টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে এই তথ্য অধিকারের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া নয়৷ অধিকার তথ্যগুলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-ছাত্রী ও জাতীয় নাগরিক কমিটির কাছ থেকে নিয়েছে৷ অধিকারের নিজস্ব অনুসন্ধান ও তালিকা তৈরির কাজ চলমান আছে বলে জানানো হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মে ও জুনে একজন করে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন৷ এপ্রিলে মারা যান দুই জন৷ মার্চ এবং আগস্টের ৬ থেকে ৩১ তারিখ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি৷
গণপিটুনি, রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু ও গুম
চলতি বছর গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৯৫ জন। এর মধ্যে আগস্টের প্রথম পাঁচ দিনেই মৃত্যু হয় ৩৫ জনের। বাকি ২৬ দিনে নিহত হন ১৪ জন। আর সেপ্টেম্বরে গণপিটুনিতে নিহত হন ১৭ জন। এছাড়া জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ২৯ জন গণপিটুনিতে নিহত হন।
রাজনৈতিক সহিংসতায় চলতি বছর ২৫৪ জন মারা গেছেন। সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটেছে ১ থেকে ৫ আগস্ট সময়সীমায়। এ সময়ে ৯৩ জন নিহত হয়েছেন৷ দেশে কোনো সরকার না থাকার তিনদিনে নিহত হন চারজন। আর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারান ৫২ জন। এছাড়া জানুয়ারিতে ২২, ফেব্রুয়ারিতে ১৫, মার্চে আট, এপ্রিলে আট, মে মাসে ১৮, জুনে ২০ ও জুলাইয়ে ১৪ জন রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হন।
চলতি বছরে ২০ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে মার্চে দুজন এবং এপ্রিল ও মে মাসে চারজন করে গুম হন। সবচেয়ে বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে জুলাইয়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার ওই সময়ে ১০ জন গুমের শিকার হন। এছাড়া জুলাইয়ে চারজন ও ৫ আগস্ট একজন সাংবাদিক নিহত হন। পাঁচটি মৃত্যুই ঘটে পুলিশের গুলিতে।
সেপ্টেম্বরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহতরা
সেপ্টেম্বরে নিহত আটজনের মধ্যে তিনজন যৌথ বাহিনীর নির্যাতনে, একজন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের নির্যাতনে, একজন পুলিশের নির্যাতনে এবং তিনজন যৌথ বাহিনীর গুলিতে নিহত হন বলে অধিকারের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার আগ পর্যন্ত আদিলুর রহমান খান মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকারের’ সম্পাদক ছিলেন। তিনি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। অধিকারের পরিচালক ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য নাসির উদ্দিন এলান বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেভাবে অস্ত্র উদ্ধারের নামে ক্রসফয়ারে বা বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হতো এখন সেরকম ঘটছে না। আমরা যে আট জনের কথা বলছি তাদের মধ্যে তিন জন যৌথ বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। বাকি পাঁচ জন পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। তবে আমরা চাই এটা যেন শূন্যে নেমে আসে।”
গণপিটুনি বা ‘মব জাস্টিসের’ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘বিগত সরকারের আমলে বিচারহীনতা এমন পর্যায়ে গিয়েছিলো এবং আদালতের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিলো। তখন প্রায়ই আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয়া হতো। সেই পরিস্থিতি এখনো কাটেনি৷ তবে পুলিশ সংস্কার নিয়ে আমরা কাজ করছি। বিচারব্যবস্থার সংস্কার নিয়েও কাজ হচ্ছে। সংস্কার হওয়ার পর এই পরিস্থিতি থাকবে না বলে আশা করি।”
তিনি বলেন, অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সময় কোনো গুমের ঘটনা ঘটেনি৷
‘সরকার বার্তা দিতে পারেনি’
মানবাধিকার কর্মী এবং গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ‘‘আমরা আগে যে অবস্থায় ছিলাম তার চেয়ে যে ভালো অবস্থানে এখন আছি তা বলার সময় এখনো আসেনি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, গণপিটুনিতে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, ডাকাতি হচ্ছে।”
তিনি মনে করেন এক্ষেত্রে সমাজের প্রতি সরকারের যে বার্তা দেয়া প্রয়োজন ছিল তা তারা দিতে পারেনি। সে কারণেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘‘আমরা কমিশন চেষ্টা করছি গুমের ঘটনাগুলো দ্রুত তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে। এরপর যদি দ্রুত বিচার শুরু হয় তাহলে একটা মেসেজ যাবে; আর আমি ব্যক্তিগতভাবে এখনো র্যাব নিষিদ্ধের দাবি করছি৷”
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘‘অধিকারের যে প্রতিবেদনের কথা আপনি বলছেন সেটা আমি দেখিনি। ফলে সেটি নিয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশ পুলিশ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না। পুলিশ এ ধরনের কাজ করে না। কিন্তু যদি কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে প্রচলতি আইনের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। দেশের প্রচলিত আইনে যাতে বিচার নিশ্চিত করা যায় সেজন্য আমরা কাজ করছি।’’