বিস্তীর্ণ এলাকার কোথাও ধানক্ষেত, কোথাও ফাঁকা মাঠ। আবার কিছু জায়গা ভরে গেছে বনবাদাড়ে। তারই ফাঁকে ফাঁকে মাথাচাড়া দিচ্ছে দু-একটি ভবন। দিনেই নির্জন; সন্ধ্যা নামতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার, গা ছমছম পরিবেশ। এ চিত্র রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল উপশহর প্রকল্প এলাকার। ১৯৯৫ সালে জনবসতি গড়ে তোলার জন্য নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার ৬ হাজার ১৫০ একর জমিতে প্রকল্প শুরু করে রাজউক। কিন্তু দীর্ঘ ২৭ বছরেও সেখানে নূ্যনতম নাগরিক সুবিধার পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। ফলে অনেকেই প্লট বিক্রি করে দিচ্ছেন।
পূর্বাচল প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক জানান, এখন সেখানে গেলে তাঁরও ভয় করে। মনে হয়, ওখানে কাউকে নিয়ে হত্যা করে ফেললেও কেউ জানবে না। তিনি বলেন, ‘অনেক কিছুই করলাম। কিন্তু এমন একটি কাজ বাকি, যা না হলে মানুষের পক্ষে বসবাস করা সম্ভব নয়। এ জন্য কত শতাংশ অগ্রগতি, তা বলে লাভ নেই।’
পূর্বাচল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রউফ সমকালকে জানান, তিনি বাড়ি বানালেও আশপাশে ধানক্ষেত ও বনজঙ্গলে ভরা। পাশেই আবার নদী। রাতে ভয়ে ভয়েই থাকছেন বলে জানান তিনি। স্থানীয় আরেক বাসিন্দা জানান, সন্ধ্যার পরই তাঁর বাড়িতে প্রধান সড়ক থেকে যাওয়ার কোনো যানবাহন থাকে না। নেই কোনো সড়কবাতি। এ জন্য সন্ধ্যার মধ্যে ফিরতে হয় বাড়িতে। ৩০০ ফুট ছাড়া কোথাও কিছু পাওয়া যায় না। এভাবে বসবাস করা নিয়ে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
‘সরকারি চাকরিজীবী’ কোটায় ৪ নম্বর সেক্টরের ৩১১বি নম্বর সড়কে তিন কাঠা প্লটের মালিক ঢাকা ওয়াসার অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, রেজিস্ট্রি-নামজারি শেষে প্লটটিতে বেশ কয়েক বছর দেয়াল দিয়ে রেখেছেন তিনি। এক সময় সেখানে বাড়ি করে বসবাসের চিন্তা থাকলেও এখন সরে এসেছেন। প্লটটি বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছেন তিনি। স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসসহ প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা না থাকায় প্লটটি বিক্রি করে ঢাকা শহরে একটি ফ্ল্যাট কেনার চিন্তা করছেন।
রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজউক প্লট বরাদ্দ এখনও শেষ করতে পারেনি। কমার্শিয়াল প্লটগুলো এখনও বরাদ্দ দিতে পারেনি। এখন দেশে ডলার সংকট চলছে। সামনে সংকটের পদধ্বনির কথা শোনা যাচ্ছে। তাহলে প্রকল্পের কাজ কীভাবে এগোবে?’ সরেজমিন দেখা যায়, বেশিরভাগ প্লটই খালি। দু-চারজন স্থানীয় বাসিন্দা অস্থায়ীভাবে একতলা-দোতলা বা টিনশেড ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন। নকশা অনুযায়ী অবকাঠামো হচ্ছে হাতেগোনা গোটাবিশেক। কিছু প্লটে সীমানাপ্রাচীর দেওয়া। কিছু প্লটে চলছে সবজি চাষ। কোনোটাতে কিছুই নেই। এমন অবস্থায় কোনো ডেভেলপার কোম্পানি পূর্বাচলের প্লটে কাজ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে থমকে আছে পূর্বাচলে জনবসতি গড়ে ওঠার কার্যক্রম।
নগর-পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘পূর্বাচলে বসতি গড়ে ওঠার চেষ্টা থাকলে আগে সেখানে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-বাজারের মতো নাগরিক সুবিধা দিতে হবে। এসবের কিছুই সেখানে নেই। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থাসহ অতি প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি রাজউক। তাহলে মানুষ কীভাবে সেখানে থাকবে?’
পূর্বাচল প্রকল্প পরিচালক মনিরুল হক বলেন, ‘এরই মধ্যে রাস্তার কাজ প্রায় ৮০ ও বিদ্যুতের ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। পানি সরবরাহের কাজ তিনটি পর্বে শেষ করা হবে। প্রথম পর্বের কাজ আগামী মার্চের মধ্যে হয়ে যাবে। এ পর্বে ১, ২ ও ৩ নম্বর সেক্টরে পানি সরবরাহ করা হবে। তখন মানুষের বাড়ি বানাতে কোনো সমস্যা হবে না।’
প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, ‘সব মিলিয়ে পূর্বাচলে ৩০ হাজার প্লট। এত বড় প্রকল্পে যাবতীয় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা সহজ নয়। আগামী ছয় মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতের চেষ্টা করব। এর পর প্রাতিষ্ঠানিক প্লট মালিকদের নোটিশ দেওয়া হবে সেখানে অবকাঠামো গড়ে তোলার। এ জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যে তাঁরা নকশা অনুমোদন না নিলে ওইসব প্লট বাতিল করা হবে। তাহলে দ্রুত সেখানে বসতি গড়ে ওঠার কাজ শুরু হবে। এভাবে চাপ না দিলে হবে না।’
সংশ্নিষ্টরা জানান, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৩০টি সেক্টরে ২৬ হাজার আবাসিক প্লট রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও বাণিজ্যিক প্লট ছাড়াও করা হবে ৬২ হাজার ফ্ল্যাট। থাকবে ১৪০ তলার আইকনিক টাওয়ার। কিন্তু এখন পর্যন্ত রাজউকের কাছ থেকে মাত্র ২৮৩টি প্লটের মালিক ভবন তৈরির নকশার অনুমোদন নিয়েছেন। হাতেগোনা কয়েকজন ভবন তৈরিতে হাত দিয়েছেন। আধুনিক শহরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো হয়নি। পাইপলাইনে গ্যাস দেওয়ার সিদ্ধান্তও বাতিল করা হয়েছে। নিরাপত্তার অভাব থাকায় বাড়ি বানিয়ে বসবাস করতে ভরসা পাচ্ছেন না প্লট মালিকরা। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক জানান, বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চারটি থানার জন্য জায়গা দেওয়া হয়েছে।
পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পে কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০১৩ সালের মধ্যে। পাঁচবার নকশা পরিবর্তন এবং সাতবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। রাজউক প্রকল্পের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ দাবি করলেও বাস্তবে তা অনেক কম। এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা সমকালকে বলেন, ‘এতদিন কাজে কিছুটা ধীরগতি ছিল মূলত ঠিকাদারের বিল বকেয়ার কারণে। বিল পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সম্প্রতি পূর্বাচলের অগ্রগতি বিষয়ে বৈঠক হয়েছে। এখন থেকে দ্রুত পূর্বাচলের কাজ চলবে।’