প্রতিবেদন প্রকাশের জেরেই হাদিউলের মতো বহু সাংবাদিক শিকার হচ্ছেন লাঞ্ছনা-হয়রানি এবং হামলা-মামলার। বিশেষ করে মফস্বলের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা এখন যেন ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অনেকের ভাগ্যে আবার কারাবরণও জুটছে। জামিন না পেয়ে চার দেওয়ালে বন্দি জীবনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা নিতে হচ্ছে অনেককে।
সাংবাদিকরা বলছেন, সমাজের দুর্নীতি, অনিয়ম ও নানা অসঙ্গতি তুলে ধরা তাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই নানা হয়রানি-হুমকির শিকার হন তারা। গত জাতীয় নির্বাচন ও সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে লাঞ্ছনা, হয়রানি ও হুমকির শিকার হয়েছেন অনেক সাংবাদিক। সংবাদ প্রকাশের পরই নয়, সংবাদ সংগ্রহকালেও লাঞ্ছনা-হয়রানি-হুমকির শিকার হন তারা। সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের ফলে সাংবাদিকরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও হুমকি এবং লাঞ্ছনার শিকার হন।
হয়রানি-মামলা বাড়ছেই
আসক মতে, গত ১০ বছরে দুই হাজার ৩১২ জন সাংবাদিক লাঞ্ছনা, হয়রানির শিকার এবং গুম ও প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৪৪২ জন, ২০১৩ সালে ৩৪২, ২০১৪ সালে ২৩৯, ২০১৫ সালে ২৪৪, ২০১৬ সালে ১১৭, ২০১৭ সালে ১২২, ২০১৮ সালে ২০৭, ২০১৯ সালে ১৪২, ২০২০ সালে ২৪৭ এবং ২০২১ সালে ২১০ জন এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন।
অনিয়ম, দুর্নীতি ও নানা অপকর্ম প্রকাশের কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জালে ফেলেও হয়রানি বা কারাবাস করানো হচ্ছে সাংবাদিকদের। ২০১৮ সালে নানা আন্দোলন ও প্রতিবাদের মুখেও জাতীয় সংসদে পাস হয় ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হওয়ার মাত্র তিন মাসেই এই আইনে সারাদেশে ৩৪টি মামলা হয়। ২০১৯ সালে এই আইনে মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৩টিতে। ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয় ৪১টি মামলা, এসব মামলায় ৭৫ সাংবাদিককে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ৩২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০২১ সালে দায়ের করা হয় ৩৫টি মামলা, আসামি করা হয় ৭১ সাংবাদিককে। এর মধ্যে ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
২০২০ সালের মার্চে বাসা থেকে বের হওয়ার পর প্রায় দুই মাস ‘নিখোঁজ’ ছিলেন ফটোসাংবাদিক ও দৈনিক পক্ষকালের সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল। পরে কাজলকে ভারত সীমান্ত থেকে ‘অনুপ্রবেশকালে’ গ্রেফতার করা হয়। এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সাত মাস কারাগারে থেকে ওই বছরের ডিসেম্বরে জামিন পান ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল।
ঝুলে আছে মামলার কার্যক্রম
একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায় বেশ কয়েকটি স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করা সাংবাদিক আব্দুল মোতালিবের বিরুদ্ধে। এরপর গ্রেফতার করা হয় তাকে। ওই মামলায় ৪৪ দিন কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পান মোতালিব।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় পড়ে জেল খেটেছি। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় কোর্টের সাইবার ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েকবার হাজিরা দিয়েছি। এখন সাক্ষীর জন্য ঝুলে আছে মামলা। প্রায় দুই বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরেও মিলছে না বিচার।
সাংবাদিক আব্দুল মোতালিবের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ময়মনসিংহের ফুলপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি করার পর আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেই। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। আদালতে মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এখন মামলাটি বিচারাধীন।
মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা এখন আদালতের বিষয়। কবে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হবে তা আমরা বলতে পারবো না।
স্বাধীন সাংবাদিকতায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন বাধা-প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সূচকেও স্পষ্ট হচ্ছে। ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) প্রকাশিত মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২০২০ সালে বাংলাদেশ ছিল ১৫১তম স্থানে, সেখানে ২০২১ সালে এক ধাপ পিছিয়ে হয় ১৫২তম।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজের অসঙ্গতি ও বাস্তব বিষয় তুলে ধরা সাংবাদিকতাকে ক্ষোভের বেড়াজালে আটকে দেওয়ার হাতিয়ার এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এর মাধ্যমে সংবিধান স্বীকৃত বাকস্বাধীনতাকে রুদ্ধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের হাতে নির্যাতন, জাতীয় কিংবা স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হামলার শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। আবার এই আইনে মামলার বিচার প্রক্রিয়ায়ও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। এতে হয়রানি যেমন বাড়ে, বাড়ে পেশাগত অনিশ্চয়তাও।
হয়রানি কমাতে পেশাগত দায়িত্ব আর উদ্দেশ্যমূলক সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের ওপরই দেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এতে নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতার ঝুঁকি যেমন কমে যাবে, তেমনি সাংবাদিকতার প্রতি মানুষের আস্থাও বাড়তে পারে।
সাংবাদিকদের হয়রানিমূলক ধারা বাতিলের পরামর্শ
মাঠ সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু
বলেন, ডিফেমেশন অ্যাক্টে যেই ধারাগুলো আছে, সেই ধারাগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নিয়ে আসা হয়েছে। এ ধরনের পানিশমেন্ট (শাস্তি) থাকা মানে মুক্ত সাংবাদিকতার বিকাশে বাধা। আমাদের উচিত হচ্ছে এখন যেহেতু আমরা একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং আমরা উন্নত হবো বলে আশা করছি। এ সময়ে আমাদের এই চর্চাগুলো পরিবর্তন করা দরকার। ডিফেমেশন অ্যাক্টকে আসলে সিভিল রং (ভুল) হিসেবে দেখা উচিত, ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে দেখা উচিত নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে ধারাগুলো যুক্ত করা হয়েছে সাংবাদিকদের জন্য, সাংবাদিকরা যে যে জায়গায় আক্রান্ত হন সেই ধারাগুলো বাতিল করা প্রয়োজন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার তদন্তে ও বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সাংবাকিদেরও ভালোভাবে জানা উচিত। সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কেউ মামলা করলে সেটার বিষয়ে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেই। বিশ্বে সাইবার অপরাধ বেড়েছে। ফলে সাংবাদিক বা অন্য যে কারও বিরুদ্ধেই মামলা হোক না কেন, তদন্ত দ্রুত করার চেষ্টা করি। বিচারের বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের ব্যাপার, আমাদের সেটি নিয়ে বলার সুযোগ নেই। বিচার দ্রুত হলে ভালো হয়। তবে সেখানে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজিরের বিষয় থাকে। সবকিছুর মূলে হলো অপরাধ কমানো।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বলেন, যারা হয়রানি করতে চান তারা এমন না যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জন্য বসে আছেন। যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন না থাকে তাহলে নন-ডিজিটাল আইনেও তারা হয়রানি করবেন। বরং এসব ধীরে ধীরে যদি নিয়ন্ত্রণ হয়, আইনে কোনো সমস্যা নেই। আর আইন কালো হয় তখন, যখন মানুষ আইনটিকে কালোভাবে ব্যবহার করে।
তিনি বলেন, দেশের বেশিরভাগ মামলায়ই দীর্ঘসূত্রতা থাকে। যেখানে এক লাখ মানুষের জন্য একজন বিচারক, সেখানে তো দীর্ঘসূত্রতা থাকবেই। শুধু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা নয়, সব মামলাই যেন দ্রুত বিচার হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবাইকে তৎপর হতে হবে, তখনই সব বিচারই দ্রুত সম্পন্ন হবে। শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নয়, সব আইনের মামলাই দ্রুত শেষ হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, একজন সাংবাদিক সত্য বিষয়টা প্রকাশ করবেন, এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে। যখন দেখবেন যে সত্য প্রকাশ হচ্ছে না বা যেটি প্রকাশ হচ্ছে সেটিতে বিকৃতি আছে, তখন সাংবাদিকতার প্রতি মানুষের আস্থা স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেটা সরকার করেছে, সেটার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আজ কত ধরনের অনিষ্ট করা যায়, সমাজের ক্ষতি করা যায়, সেটা আমরা প্রতিনিয়তই দেশে ও বিদেশে দেখছি। কিন্তু কোনো সাংবাদিকের কাজের ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে সরকারের নজর রাখতে হবে। কারণ একজন সাংবাদিকের তথ্য বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে, সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। কিন্তু তারপরও ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকতে পারে, সেই ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্যই সাংবাদিকতায় যে ব্যাকরণ আমরা অনুসরণ করি, তাতে কোনো ভুল তথ্য যদি প্রকাশ পায় সেটাকে সংশোধন করার চর্চা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, সংশোধনের দায়িত্ব সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকেরই। সামাজিক যে মাধ্যম আছে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেমন দরকার, আবার সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের ওপর প্রয়োগের বিষয়ে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সত্যিকার অর্থে কাজ করতে গিয়ে কোনো ভুল-ত্রুটির কারণে যেন সাংবাদিকরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় না পড়েন, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, প্রেস কাউন্সিল, সাংবাদিক ইউনিয়নকে এই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। ভুলটা কী ধরনের এবং কতটুকু—তারা তা দেখবে। এটা বুঝতে পারবেন সাংবাদিকতা পেশায় যারা আছেন তারাই। এটা তারাই মূল্যায়ন করতে পারবেন, অন্যদের দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ সাংবাদিকতা পেশা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও ডেডলাইনভিত্তিক পেশা। তাকে একটি সময়ের মধ্যে রিপোর্টটি করতে হয়। অনেক সময় এমন হতে পারে যে তথ্য পরিবেশন করেছেন সেটি সঠিক ছিল না। কিন্তু সেটা তো সংশোধনের সুযোগ আছে, সারা দুনিয়ায় সাংবাদিকতা সেভাবেই চলে। তাকে সে কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা বা জিজ্ঞাসাবাদ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সেটি নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতার মধ্যে পড়ে যাবে। আর সেই সাংবাদিকতায় মানুষের আস্থা কমে যাবে।