১৫ বছর ধরে শিকলবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন হোসেন আলী সরদার (২২) নামে এক যুবক। জন্ম থেকে তিনি বাক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। প্রতিদিন বাড়ির পেছনে রাস্তার ধারে শিকলবন্দী অবস্থায় তাকে রাখা হয়। তিনি সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শুকদেরপুর গ্রামের দিনমজুর মালেক সরদারের বড় ছেলে। অন্যত্র চলে যাবে- এই ভয়ে তাকে শিকলবন্দী করে রাখা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হোসেন আলীকে বাড়ির পেছনে রাস্তার ধারে শিকলবন্দী করে রাখা হয়েছে। তিনি পথচারীদের কাছে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে খাবার চাইছেন। তার আকুতি দেখে অনেকেই তাকে খাবার কিনে দেন। পথচারীদের উপহার পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। শিকলবন্দী এই জীবন কত কষ্টকর সেটা তাকে দেখলে বুঝতে বাকি থাকে না।
হোসেন আলী প্রতিবন্ধী হলেও বাবা-মায়ের কাছে চোখের মণি। তাকে হারাতে চান না তারা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হোসেন আলীকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর কথা থাকলেও নির্যাতনের ভয়ে তাকে সেখানে দেননি বাবা-মা, বাড়িতে শিকলবন্দী করে রেখেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ইমরান হোসেন জানান, অনেক কষ্ট করে জীবন পার করছেন হোসেন আলী। তার শিকলবন্দী জীবন দেখে প্রতিবেশীসহ সবার খারাপ লাগে। তবে কিছু করার নেই। কারণ তাকে ছেড়ে দিলে দূরে চলে যায়। অনেক দিন নিখোঁজ থাকে।
হোসেন আলীর বাবা মালেক সরদার বলেন, ছোটবেলায় অন্য শিশুদের থেকে ভিন্ন আচরণ করত হোসেন আলী। সে কথা বলতে পারত না। বিভিন্ন রকম অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ করত। একপর্যায়ে তাকে আমরা বিভিন্ন ডাক্তার ও কবিরাজ দেখানোর পরে জানতে পারি- সে প্রতিবন্ধী। ছোটবেলায় তাকে ছেড়ে দিয়ে রাখলে সে বিভিন্ন স্থানে চলে যেত। কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর তাকে বহু কষ্টে খুঁজে পাওয়া যেত। তাই বাধ্য হয়ে তাকে ১৫ বছর ধরে শিকলবন্দী করে রেখেছি। আমাদের থেকে দূরে চলে যাওয়া ঠেকাতে এটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
তিনি আরও বলেন, অনেক চিকিৎসক দেখানোর পরও তাকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর কথা থাকলেও নির্যাতনের ভয়ে সেখানে পাঠায়নি। শুনেছি পাবনা মানসিক হাসপাতালে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।
হোসেন আলীর মা আছিয়া বেগম বলেন, তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে হোসেন আলী মানসিক প্রতিবন্ধী। সে বিভিন্ন জায়গায় চলে যেত। তাকে খুঁজে পেতে আমাদের খুব কষ্ট হতো। তাকে ছাড়া আমরা থাকতে পারি না। তাই বাধ্য হয়ে তার পায়ে শিকল দিয়ে রাখি। সকালে তাকে ঘর থেকে বের করে বাড়ির পেছনে রাস্তার ধারে শিকলবন্দী করে রাখি। সন্ধ্যায় তাকে উঠিয়ে নিজ হাতে গোসল করিয়ে ভাত খাওয়াই। তারপর ঘরের মধ্যে তালাবন্দী করে রাখি। এটা আমার নিত্যদিনের কাজ। গত ১৫ বছর যাবত এই কাজ আমি করে আসছি। সে যদি মারা যায় তাহলে আমার কাছে থেকে মারা যাক। তবুও তাকে আমি দূরে যেতে দিতে চাই না।
তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ জানান, হোসেন আলীকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া সরকারি সুবিধা এলে তাকে সেটা দেওয়া হবে।
তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিচালক রাজিব সরদার জানান, ছেলেটা মানসিক প্রতিবন্ধী। স্থানীয়ভাবে তার ভালো চিকিৎসা সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তবে বয়স বেড়ে যাওয়ায় এখন আর সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা খুব কম।