দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৫৪ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৯১১ জন চিকিৎসক। একই সময়ে সারা দেশে ২ হাজার নার্স এবং ৩ হাজার ২৯৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হন। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) এ তথ্য জানিয়েছে। বিএমএ’র পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শুধু গত বছরের জুন মাসে মারা গেছেন ৪৫ জন চিকিৎসক। যার মধ্যে ৪ঠা জুন একদিনেই পাঁচজন চিকিৎসক মারা যান। যেটা ছিল একদিনে সর্বোচ্চসংখ্যক চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনা। করোনা হানা দেয়ার পর থেকেই চিকিৎসকদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়।
সকল শিডিউল ওলট পালট হয়ে যায়। করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজেরা করোনায় আক্রান্ত হন। একটি সরকারি হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক ডা. রাজীব। মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসক হিসেবে রয়েছে তার ব্যাপক সুনাম। করোনাকালে আক্রান্ত রোগীদের করোনা ইউনিটে একইভাবে চিকিৎসাসেবা দিয়ে এসেছেন। সম্প্রতি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় একাধিক পুরনো রোগী এসে তাকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে অন্য চিকিৎসকের চিকিৎসা নিচ্ছেন। কথা হয় ডা. রাজীবের সঙ্গে। তিনি বলেন, করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই করোনা ইউনিটে ডিউটি করতে হচ্ছে।
শিফ্ট অনুযায়ী ডিউটি করতে হয়। তিন শিফটে কখনো ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত টানা কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, এমন দায়িত্বে আছি আমরা যেখানে নিয়মিত ক্লান্তিহীন ডিউটি করতে হয়। ডিউটি শেষে বাসায় ফিরে মন চাইলেও প্রিয় সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করতে পারি না। চোখের সামনে যখন খুব কাছের সহকর্মী চিকিৎসককে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে দেখি তখন অনেক সময় নিজের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আরেক সরকারি হাসপাতালের নারী চিকিৎসক বলেন, করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর গত বছরের মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত আমরা সামনের সারিতে থেকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের লড়াইটা কিন্তু এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।
কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের হারিয়েও নিজের দায়িত্ব থেকে এক পা’ও সরে আসেননি। এই সেবার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সময় আমরা শপথ নিয়েই এই পেশায় এসেছি। যেকোনো বিপর্যয়ে মানুষকে সেবা দিয়ে যেতে হবে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর গত ২৪ দিনে ১৫ চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। করোনায় দেশে প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু হয় গত বছরের ১৫ই এপ্রিল। সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দীন আহমেদ ওইদিন মারা যান। গত শনিবার রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ সামসুজ্জামান মারা যান। এর আগে গত ১৭ই এপ্রিল বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু আহমেদ আশরাফ আলী মারা যান।
গত বছরের জুনে প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো এলাকা থেকে আসত চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর। মাঝে মৃত্যুর সংখ্যা কমলেও চলতি বছরের এপ্রিলে এসে আবার তা বেড়ে যায়। প্ল্যাটফর্ম অব মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল সোসাইটির তথ্যসূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে, করোনার উপসর্গ নিয়ে মোট ২০০ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি বছরে নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত থেকে শুরু করে নানা কারণে বেড়েছে চিকিৎসকদের মৃত্যু।
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন চিকিৎসকদের মৃত্যুর বিষয়ে মানবজমিন-এর সঙ্গে কথা বলেন। মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, আমরা যখন চিকিৎসা পেশায় যোগদান করি সাধারণ মানুষের সেবা করতে তখন ব্রত নিয়েই এসেছি। প্রথম পর্যায়ে সেবা দিতে গিয়ে আমাদের কিছু কিছু ঘাটতি ছিল। করোনাভাইরাস কি এটা শুধুমাত্র আমরা নয়, পৃথিবীর অনেক দেশই বুঝতে পারেনি। তারপরেও আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রথম সারিতে থেকে লড়াই করেছি। এখনো করছি।