দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যখন দেশের মানুষ দিশেহারা তখন দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেই তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে সবকিছুর উপর। বর্তমান সরকারের ১৪ বছরের মেয়াদে গ্রাহক পর্যায়ে এ পর্যন্ত ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এছাড়া পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে ১২ বার। তবে সরকারের ইঙ্গিত অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানো হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সর্বশেষ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে ৫ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। যা পরদিন (১ মার্চ) থেকেই কার্যকর করা হয়েছে। সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, খুচরা পর্যায়ে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা ১৪ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৩৫ পয়সা। শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর (প্রথম ধাপ) ক্ষেত্রে ৪ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ টাকা ৮৫ পয়সা। ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের (দ্বিতীয় ধাপ) ক্ষেত্রে ৬ টাকা ৩১ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ৬৩ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের (তৃতীয় ধাপ) ৬ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের (চতুর্থ ধাপ) জন্য ৬ টাকা ৯৯ পয়সা থেকে বেড়ে ৭ টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের (পঞ্চম ধাপ) জন্য ১০ টাকা ৯৬ পয়সা থেকে বেড়ে ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের (ষষ্ঠ ধাপ) ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকের বিল ১২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বেড়ে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা করা হয়েছে।
এছাড়া সেচ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রাস্তার বাতিসহ অন্যান্য বিদ্যুতের দামও বাড়িয়েছে সরকার। কৃষিতে ব্যবহৃত সেচযন্ত্রের বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ টাকা ৮২ পয়সা, যা ৩১ জানুয়ারি বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৪ টাকা ৫৯ পয়সা। শিক্ষা, ধর্মীয়, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা ৬৪ থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৯৭ পয়সা করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্পে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ৯ টাকা ৪১ থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৮৮, রাস্তার বাতি ও পানির পাম্পে ৮ টাকা ৪৯ থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৯১, ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের ক্ষেত্রে ৮ টাকা ৪২ থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৮৪, বাণিজ্যিক ও অফিস ফ্ল্যাটে ১১ টাকা ৩৬ থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯৩ এবং নির্মাণ শিল্পের বিদ্যুতের দাম ১৩ টাকা ২৩ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩ টাকা ৮৯ পয়সা।
এ নিয়ে চলতি বছরের দুই মাসে তিন দফা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে লাইফলাইন গ্রাহকের ইউনিটপ্রতি খরচ বেড়েছে ৬০ পয়সা, ৭৫-৬০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম বেড়েছে ৬৬ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত। এছাড়া তিন দফায় ইউনিটপ্রতি খরচ বেড়েছে সেচের বিদ্যুতে সর্বোচ্চ ৬৬ পয়সা; শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য ও হাসপাতালের ক্ষেত্রে ৯৫ পয়সা; রাস্তার বাতির জন্য ১ টাকা ২১ পয়সা; ব্যাটারি চার্জিংয়ে ১ টাকা ২০ পয়সা; বাণিজ্যিক অফিসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৬৩ পয়সা ও নির্মাণ শিল্পের জন্য ১ টাকা ৮৯ পয়সা।
এদিকে বর্তমান সরকারের টানা ১৪ বছরের মেয়াদে গ্রাহক পর্যায়ে ১৩ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আর পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে ১২ বার। অবশ্য মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাও বেড়েছে। ২০০৯ সালের তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ গুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৮২৬ মেগাওয়াটে।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। ২০১০ সালের মার্চে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখন গড় বিদ্যুৎ বিল বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৯২ পয়সা। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফায় ৫ শতাংশ ও ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ টাকা ৬৭ পয়সা। এভাবে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েক দফা বাড়ে বিদ্যুতের দাম। মাঝে ২০১৮-২০১৯ এ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। এরপর ফের ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের দাম সব পর্যায়ে বাড়ানো হয়। তখন পাইকারিতে দাম ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। তাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা ১৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। সবমিলে ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সালের প্রথম দুই মাস পর্যন্ত ১৪ বছরে বিদ্যুতের দাম ১৩ বার বাড়ানো হয়।
তবে বিদ্যুতের আরও কয়েক দফা বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত জানুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হবে। তবে পর্যায়ক্রমে অল্প অল্প করে সমন্বয় করা হবে যেন জনগণের কষ্ট না হয়। এছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তাও এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম ঢাকা মেইলকে বলেন, এভাবে মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের ওপর অনেক চাপ পড়ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। সবকিছুর উপর এর প্রভাব পড়ছে। সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে ঠিক। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় কিভাবে বাড়ছে এটা তো আমরা বুঝতে পারছি না। এখন তো আর গণশুনানি হচ্ছে না। সরকার নির্বাহী আদেশে ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে। কাজেই কোনো বিদ্যুৎ প্লান্টকে সরকার বসিয়ে খরচ দিচ্ছে না কি করছে সেটা তো বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। সরকার যদি আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে কাজ করত, কয়লার বিষয়টা আগে থেকেই চিন্তা করে রাখত, তবে এখন এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো না।
সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, সরকার বলছে, উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় করে কমমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। তাই ঘাটতি পূরণের জন্যই দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি বা সমন্বয় করা হচ্ছে। কথা একদম ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো- সরকার উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কেনার সময় কি সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিল? জনগণকে অন্ধকারে রেখে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সরকার উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনেছে। আবার কিছু ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়ার জন্য উৎপাদন না করেও বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা জনগণের পকেট থেকে তুলে নিচ্ছে। ভর্তুকির নামে এক ধরনের লীলাখেলা, অনেকটা জাদুর ভেলকির মতো একদিক দিয়ে নিয়ে আরেক দিকে বের করা।