রীতিমতো লাগামহীন হয়ে পড়েছে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ। এটি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না। ফলে বিদায়ি বছরে (২০২১) খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর ২০২০ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বাড়ল ১৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণসংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। প্রতিবেদনটি বুধবার অনুমোদন করেছেন গভর্নর ফজলে কবির। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ কমাতে ঢালাও সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনার কারণে গেল বছরও ঋণ পরিশোধে ছাড় ছিল। গত বছর যে অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল তার মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করার পর কাউকে খেলাপি করা হয়নি। এরপরও খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। উল্টো বেড়েই চলেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে তাকে খেলাপি করা হয়নি। ফলে আদায় তলানিতে নামলেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। বছর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক কমে দাঁড়ায় ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকায়। যা ওই সময়ের বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কিন্তু ২০২১ সালে বিশেষ সুবিধার ছাড় কিছুটা কমায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্দেশনায় বলা হয়, গেল ডিসেম্বরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে ঋণের ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলেই কেউ আর খেলাপি হবেন না। এরপরও ঋণখেলাপি বাড়তে থাকে। গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ গিয়ে ঠেকে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। পরে বিভিন্ন মহলের চাপে খেলাপি ঋণ কমাতে নতুন ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বলা হয়, ২০২১ সালে একজন ঋণ গ্রহীতার যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা, তার ১৫ শতাংশ দিলে গ্রাহক খেলাপি হবে না। গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেওয়া নির্দেশনার আলোকে কেউ ২০ জানুয়ারির মধ্যে ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলেও গ্রাহক খেলাপি হয়নি। তারপরও আশানুরূপ খেলাপি ঋণ কমাতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ১ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ সময় সরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করে ২ লাখ ৩৩ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৪৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করে ৯ লাখ ৭০ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৫১ হাজার ৫২১ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৬৪ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ২ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। বিশেষায়িত তিন ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়েছে ৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এ অঙ্ক বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ০২ শতাংশ। ব্যাংক তিনটি ঋণ বিতরণ করেছে ৩৩ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সুযোগ দিয়ে লাভ নেই। তারা ঋণ পরিশোধ করবে না। উল্টো একের পর এক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা পার পেয়ে যাবেন। তাই ঢালাও সুযোগ কমিয়ে দেওয়া দরকার। তবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের কেস-টু-কেস সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, খেলাপি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এগুলো কেউ মানছে না। যদি নির্দেশনা না মানে তাহলে তা দিয়ে কী লাভ? তাই অযথা নির্দেশনা না দিয়ে ভালো হবে ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেবে। যদি তা অর্জন না হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন সাবেক এ গভর্নর।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও যখন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। তবে প্রকৃত চিত্র দেখা যাবে মার্চ প্রান্তিকে। কারণ তখন কোনো ছাড় থাকবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এর পরের বছর ২০১৮ সালে খেলাপি ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা এবং ২০২০ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা।