দেশে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ ও ব্যবহার বন্ধ করতে পারছে না এ খাতের সরকারি সংস্থা ও কোম্পানিগুলো। নতুন নতুন অবৈধ সংযোগ স্থাপনের পাশাপাশি বিচ্ছিন্ন হওয়া অনেক অবৈধ সংযোগও আবার স্থাপিত হচ্ছে। চুরি হওয়া এ গ্যাসের মধ্যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আনা এলএনজিও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উত্পাদিত গ্যাস চুরি হওয়ায় তার আর্থিক ক্ষতি অপেক্ষাকৃত কম হতো। এখন আমদানি করা ব্যয়বহুল এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) মেশানো গ্যাস চুরি হওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গেছে। একসময় বিপুল মুনাফা অর্জনকারী গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর কয়েকটি এখন লোকসান গুনছে। কয়েকটির লাভ কমে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, বিতরণ কোম্পানিগুলোর কর্মচারী ও ঠিকাদাররা মাঠ পর্যায়ে এ গ্যাসচুরির কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহযোগিতা নিয়ে স্থানীয়রা বাধা দিচ্ছে। অনুমোদনহীন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর স্থানীয় গ্যাস অফিসে হামলার চেষ্টাও হচ্ছে।
বাংলাদেশ তেল গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্রে জানা যায়, ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির অধীনে প্রায় ৪৩ লাখ বৈধ গ্যাস-সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগ আবাসিক খাতের। মোট সংযোগের ৬০ শতাংশের বেশি তিতাস গ্যাস কোম্পানির। বর্তমানে তিতাসের গ্রাহকসংখ্যা ২৮ লাখ ৬৬ হাজার। এর মধ্যে ২৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯ জন আবাসিক গ্রাহক।
২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট পর্যন্ত দেশে শুধু দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস ব্যবহূত হতো। ঐ বছরের ১৯ আগস্ট থেকে দেশজ গ্যাসের সঙ্গে এলএনজি মিশিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ শুরু হয়। ব্যয়বহুল এ গ্যাসের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর দেশে গ্যাসের গড় দাম বাড়তে শুরু করে। আগে গ্যাস কোম্পানিগুলো প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মুনাফা করলেও সাম্প্রতিক দুই বছর অর্থ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ঘাটতি আরো বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি করা হচ্ছে এলএনজি। বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি এবং দেশে তা বিতরণ করতে বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয় পেট্রোবাংলা এবং এর আওতাধীন কোম্পানিগুলোর। তাই অপব্যবহার ও অপচয় রোধে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই সতর্ক করে আসছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কাজে আসেনি।
অবৈধ গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ ও পাইপলাইন অপসারণ করার কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে তদারক করছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের একটি কমিটি। সম্প্রতি ঐ কমিটির সভায় জানানো হয়, গত ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৩ মাসে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫২৭টি অবৈধ গ্যাস-সংযোগ চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সময়ে ৬৭২ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন চিহ্নিত করা গেছে। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ১৫ দিনে নতুন করে আরো ১০ হাজার ১৬০টি অবৈধ সংযোগ এবং ১৬ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন চিহ্নিত করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ কমিটির এক সদস্য জানান, দেশে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ ও ব্যবহার পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র চিহ্নিত চিত্রের চেয়েও ভয়াবহ। কমপক্ষে তিন গুণ বেশি অর্থাত্ প্রায় ১০ লাখ অবৈধ সংযোগ ও ২ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ অবৈধ পাইপলাইন আছে। এগুলো শনাক্তের কাজ চলছে। তবে মাঠপর্যায়ে কঠোরভাবে অভিযান পরিচালনা এবং রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন না ঘটলে তা অসম্ভব হয়ে যাবে।
করোনা সংক্রমণ শুরুর কয়েক মাসে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিযান পরিচালনা করা যায়নি। তবে এ সময় অবৈধ সংযোগ বন্ধ থাকেনি। এর প্রতিফলন দেখা যায় সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের বিবরণে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোম্পানিটির আওতাধীন এলাকায় মাত্র ৩ হাজার ৯১১টি গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে অভিযান বেড়েছে। গত মার্চ মাসেই ৪০ হাজার ১৬৫টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি ৮৪ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন উচ্ছেদ করা হয়। গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট সাড়ে ১৩ মাসে ছয়টি বিতরণ কোম্পানি ৩ লাখ ২৭ হাজার ৪৯টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং ৫৮৩ দশমিক ১৮ কিলোমিটার অনুমোদনহীন পাইপলাইন উচ্ছেদ করেছে।